পারুল আক্তার (১৫)। টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার গরিয়া গ্রামের স্বচ্ছল কৃষক আ. কুদ্দুছ খাঁর মেয়ে ছিলেন। পড়াশোনা করছিলেন দশম শ্রেণিতে। বাবার ইচ্ছা ছিল নিজ হাতে মেয়ের বিয়ে দেবেন। কিন্তু পারুল তা হতে দেননি। পালিয়ে বিয়ে করেন প্রেমিক নাছির উদ্দিন বাবুকে (১৯)। এতে ক্ষোভ হয় তার বাবার। মেয়েকে ফুসলিয়ে এনে হত্যা করেন। এ ঘটনায় জামাতাকে ফাঁসাতে তৈরি করেন নানা ছক। মামলার পর মামলা, না-রাজি; কত কিছুই না করেছেন। কিন্তু, আইনের ফাঁক গলে নিজে বাঁচতে পারেননি। ধরা পড়েছেন কুদ্দুছ।
মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর নিজের স্বপ্নভঙ্গ ও সম্মানহানির ঘটনায় পারুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কুদ্দুছ খাঁ। অপেক্ষা করছিলেন মোক্ষম সময়ের। একসময় মিলেও যায় যে সুযোগ। হাতছাড়া না করে প্রথম সুযোগেই মেয়েকে বন্ধুর বাড়ি নিয়ে হত্যা করেন। টানা ৮ বছর ধরে মেয়ের জামাই নাছিরকে ফাঁসাতে একের পর এক মামলা চালিয়ে আসছিলেন। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), সিআইডি তার মামলার তদন্ত করে। কোনো মামলায় নাছিরের সংশ্লিষ্টতা পায়নি সংস্থাগুলো। কিন্তু আদালতে প্রতিবেদন দিলে কুদ্দুছ তার পরিপ্রেক্ষিতে না-রাজি দিতেন।
পরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সম্পূরক তদন্ত শুরু করে পিবিআই ঢাকা জেলা। এতেই বের হয় হত্যার রহস্য। ২০১৫ সালে পারুলের বাবা তার বন্ধু মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ে পারুলকে নিজ হাতে হত্যার কথা স্বীকার করেন পিবিআই'র কাছে। এরপর আদালতের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। রোববার সকালে ধানমন্ডির পিবিআই হেডকোয়ার্টারে এক সংবাদ সন্মেলনে সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার এ তথ্য জানায়।
তিনি বলেন, ঘটনা ২০১২ সালের। পারুল আক্তার ও নাছির উদ্দীন সরকার একে-অপরকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেন। পারুলের পরিবার এমন প্রেমের বিয়ে মানতে পারেনি। বিয়ের পরে অল্প বয়সী এই দুজন আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকুরি নিয়ে ভাড়া বাড়িতে সংসার পাতেন। সাংসারিক জীবনে শুরু হয় টানাপোড়েন। এক পর্যায়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা পারুল বাবা আব্দুল কুদ্দুস খাঁকে মুঠোফোনে বিস্তারিত জানিয়ে সাহায্য চান। কুদ্দুস মেয়েকে সুন্দর ভবিষ্যৎ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসে স্বামী নাছিরকে ছেড়ে যেতে বলেন। সুযোগ বুঝে পারুল গত ২০১৫ সালে ১৮ জুলাই স্বামীকে না জানিয়ে চলে যান বাবার কাছে।
পরদিন বাবা কুদ্দুস মেয়ে নিয়ে যান ভুঞাপুরে তার বন্ধু মোকা মন্ডলের বাড়িতে। সেখান থেকে মোকা মণ্ডল ভবিষ্যতে পারুলকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কিছুদিন তার স্বামী নাছিরের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে। এই আশ্বাস দিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় তুলসীগঙ্গা নদীর পাশে একটি নির্জন জায়গায় রাতের অন্ধকারে ভিকটিমকে তার বাবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এরপর মোকা মন্ডলের সহযোগিতায় পারুলের পড়নের ওড়না দুই টুকরা করে হাত-পা বেধে ফেলে। তারপর গলা টিপে হত্যা করে। এরপর মেয়ে জামাতা নাছির ও তার পরিবারকে ফাঁসাতে একটি গুমের মামলা করেন পারুলের বাবা।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার বলেন, ঘটনার পরে মামলার তদন্তে কালিহাতি থানা-পুলিশ প্রেমের বিয়ের সংশ্লিষ্টতা পায়। কিন্তু ভিকটিম পারুলকে না পওয়ায় এবং ঘটনাস্থল কালিহাতী থানার আওতাধীন না হওয়ায় এই মামলা তাদের এখতিয়ারের বাইরে বলে প্রতিবেদন দাখিল করে। এবার মামলার বাদি পারুলের বাবা কুদ্দুসের বারবার নারাজীর প্রেক্ষিতে টাঙ্গাইলের ডিবি পুলিশ,পিবিআই ও সিআইডি তদন্তে নামেন। তারাও কোন কুলকিনারা করতে না পেরে একই প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। এরপরও খুনি বাবা খ্যান্ত হচ্ছিলেন না। সবশেষে কুদ্দুস খাঁ আগের তদন্তের রেফারেন্সসহ মামলা করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে। অভিযোগ করা হয় নাছির উদ্দীন যৌতুকের জন্য তার মেয়ে পারুলকে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন। গত ডিসেম্বরে দায়ের করা এই মামলার তদন্ত ভার পায় পিবিআই।
অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার বলেন, পিবিআই তদন্তে নেমে একটি মোবাইল নাম্বারের সুত্র ধরে এগোতে থাকে সংস্থাটি। প্রথমে গফরগাও থেকে গ্রেফতার করা হয় পারুলের স্বামী নাছিরকে৷ তারপর ডাকা হয় পারুলের পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে। নাছিরসহ পারুলের পরিবারের সবাই অসংলগ্ন তথ্য দিতে থাকেন। দুই পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পারুলের বাবা তার বন্ধু মোকা মন্ডলকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ে পারুলকে নিজ হাতে হত্যার কথা স্বীকার করেন পিবিআই'র কাছে। এরপর আদালতের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেন।
নিজ হাতে মেয়েকে খুন করার পরেও নানা পর্যায়ে আইনি লড়াই কেন করলেন পারুলের বাব? এমন প্রশ্নের জবাবে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘এটি একটি অনার কিলিংয়ের ঘটনা। মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা কুদ্দুস ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে হেয় ও সম্মানহানির শিকার হয়েছেন। তাই শাস্তি হিসেবে মেয়েকে খুন করেছেন। কিন্তু এই সন্মানহানীর পেছনে তাঁর মেয়ের সঙ্গে জামাতা নাছিরেরও সমান হাত আছে৷ তাই মেয়ের মতো জামাতা নাছিরকেও শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন কুদ্দুস। তিনি (কুদ্দুস) চেয়েছেন এই খুনের মামলায় নাছিরের যেন ফাঁসি হয়। তাহলেই তার সন্মানহানীর প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হবে। এই জন্যই নিজে মেয়েকে খুন করেও বিভিন্ন পর্যায়ে আইনি লড়াই করেছেন তিনি।’