আগামী মার্চে একই সঙ্গে সেচ মৌসুম আর রমজান মাস শুরু হচ্ছে। তখন গরমের পাশাপাশি সেচের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়বে। এর মধ্যে বিদ্যুত্ ও জ্বালানির বকেয়া পরিশোধে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি কম্পানিগুলোর চাপ বেড়েছে।
গত রবিবার বিদ্যুত্ সরবরাহ বাবদ বকেয়া বিল পরিশোধে নতুন করে সময় বেঁধে দিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) চিঠি দিয়েছে ভারতীয় আদানি গ্রুপ। চিঠিতে আগামী জুনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার বিদ্যুত্ বিভাগের সচিব ফারহানা মমতাজের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় বেসরকারি বিদ্যুত্ উত্পাদনকারীরা রমজান ও বোরো সেচের বিদ্যুত্ পেতে আগামী ১০ দিনের মধ্যে অন্তত বকেয়া পাওনার অর্ধেক পরিশোধ করতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে। মোট বকেয়ার অর্ধেক তারা না পেলে আসন্ন গ্রীষ্মে অতিরিক্ত বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হবে বলে জানিয়েছেন উত্পাদনকারীরা।
সম্প্রতি সরকারকে চিঠি দিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানি শেভরন, এলএনজি সরবরাহকারী কম্পানি কাতার গ্যাস। তবে জ্বালানি তেল আমদানিতে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া না জমলেও ডলার সংকটের কারণে তেল সরবরাহকারী বিদেশি কম্পানিগুলোকে পেমেন্ট দিতে কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ডেভিড হাসনাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিপিডিবির কাছে আমাদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দিয়ে আসছি।
ডেভিড হাসনাত বলেন, ‘আমাদের সিঙ্গাপুর থেকে তেল আমদানি করতে হয়। এতে এলসি খোলা থেকে বিদ্যুেকন্দ্রে তেল পৌঁছানোর জন্য প্রায় ৪৫ দিন সময় প্রয়োজন হয়। মার্চ থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুত্ দিতে হলে যে তেল প্রয়োজন হবে। সে জন্য এই মাসের মধ্যে আমাদের এলসি খুলতেই হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা পিডিবিকে আমাদের বকেয়ার অন্তত অর্ধেকটা দিতে বলেছি। আজকালের মধ্যে যদি পাওয়া যায়, আমরা এলসি খুলে তেল আমদানি করতে পারব।’
বিদ্যুত্ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গ্রীষ্মে দেশে বিদ্যুত্ চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। গত ২০ জানুয়ারি দুপুরে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট। এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে হতে পারে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুেকন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত জ্বালানির সরবরাহ করা না গেলে ব্যাপকভাবে ব্যাহত হতে পারে বিদ্যুত্ উত্পাদন। এতে লোডশেডিং বেড়ে বোরো সেচ মৌসুম কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, জুনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের জন্য বিপিডিবিকে চিঠি দিয়েছে আদানি গ্রুপ। এর আগে গত বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দিয়েছিল তারা। ওই সময় একটি ইউনিট থেকে উত্পাদনও বন্ধ করে চাপ দেয় তারা। গত রবিবার বিপিডিবিকে পাঠানো চিঠিতে আদানি বলেছে, বিপিডিবির কাছে তাদের পাওনা ৮৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বিপিডিবিকে সরবরাহ করা বিদ্যুতের বিল হিসেবে এই বকেয়া জমেছে বিপিডিবির কাছে। জুনের মধ্যে বিল পরিশোধ করা না হলে চুক্তি অনুসারে বিলম্ব ফি হিসেবে পরিশোধ করতে হবে বিপিডিবির।
বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, বিলে কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ আছে। চুক্তিতে উল্লিখিত সূত্র অনুসারে কয়লার দাম হিসাব করছে আদানি। আর কয়লার প্রকৃত দাম ধরে বিল হিসাব করছে বিপিডিবি।
বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে জানতে বিপিডিবির সদস্য (অর্থ) (যুগ্ম সচিব) অঞ্জনা খান মজলিশের সঙ্গে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আদানির বকেয়া পাওনা পরিশোধে বিদ্যুত্ বিভাগ ও অর্থ বিভাগের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক হচ্ছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
তিনি বলেন, ‘বকেয়া শোধের বিষয়টি আগেই মৌখিকভাবে জানিয়েছিল আদানি। আনুষ্ঠানিক চিঠি গত রবিবার বিপিডিবির কাছে এসেছে। বকেয়া পরিশোধে করণীয় ঠিক করা হচ্ছে।’
এদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধে চিঠি দিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানি শেভরন এবং কাতার এনার্জি। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের কাছে গ্যাস বিক্রি বাবদ শেভরনের ২২০ মিলিয়ন ডলার বাকি। এই অর্থ পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে অন্তত ৭৫ মিলিয়ন ডলার দ্রুততার সঙ্গে পরিশোধ করার তাগিদ দিয়েছে।
একই দিন কাতারের রাস লাফফান লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস কম্পানি লিমিটেডের (কাতার গ্যাস বা কাতার এনার্জি নামে পরিচিত) কাছ থেকে আরেকটি চিঠি পায় জ্বালানি বিভাগ। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিক্রি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ১৫০ মিলিয়ন ডলার। এই চিঠিতেও পাওনা অর্থ দ্রুত পরিশোধের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, জ্বালানি বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের বকেয়া পরিশোধ করা সম্ভব হবে। মূলত ডলার রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এতে নিয়মিত পেমেন্ট দেওয়া যাচ্ছে না।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শেভরন ও কাতার গ্যাস বিল পরিশোধে তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি আগামী সপ্তাহে তাদের বকেয়া টাকা কিছু পরিশোধ করার। এর মধ্যে কাতারের গ্যাসের বকেয়া জরুরি ভিত্তিতে পরিশোধ করতে হবে।’
জিটুজি ভিত্তিতে কাতারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করছে পেট্রোবাংলা। এই এলএনজির মূল্য বাবদ বকেয়া পড়ে যাওয়া ১৫০ মিলিয়ন ডলার দ্রুততার সঙ্গে পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছে কাতার গ্যাস।
তাদের ভাষ্য মতে, জিটুজি চুক্তির আওতায় নির্দিষ্ট সময়ে বকেয়া পরিশোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পেট্রোবাংলা। সেটি করা না হলে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ঝুঁকি তৈরি হওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। আবার শেভরনের জরুরিভিত্তিতে চাওয়া ৭৫ মিলিয়ন ডলারও পরিশোধ করে দিতে চায় জ্বালানি বিভাগ। শেভরন বাংলাদেশের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা থেকে গ্যাস উত্তোলন করে সরবররাহ করছে, যা মোট দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাস উত্পাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং দেশীয় কনডেনসেট উত্পাদনের ৮৩ শতাংশের মতো।