Image description

গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে ৪০ লাখ কোটি টাকা। একই সময়ে দেশে নতুন করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে ছোট-বড় মাত্র ৪০ লাখ ৫৮ হাজার খানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সেবা খাতে ৩৯ লাখ ১৯ হাজার এবং ম্যানুফ্যাকচারিং (উৎপাদন) খাতে যুক্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৫টি প্রতিষ্ঠান। গত ১০ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের। অথচ ২০১৩ সালে বেড়েছিল দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাক্-প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিগত সময়ে জিডিপির আকার যে হারে বেড়েছে, সেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র বাড়েনি। এ কারণে প্রত্যাশা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি, বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছেই। গত ১০ বছরে সাড়ে ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও ২০২৪ সালেই বেকার হয়েছে ৬২ লাখ মানুষ। টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে এই অবস্থার উন্নতি করতে হবে।

জানতে চাইলে অর্থনৈতিক শুমারি প্রকল্পের পরিচালক এস এম শাকিল আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত ১০ বছর বড় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। নানা কারণে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর বৃদ্ধি না পেলেও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। এতেই বোঝা যায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়নি।

সরকার অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানতে ১০ বছর পর অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাক্-প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৩ প্রকল্পের অধীনে নেওয়া এ প্রতিবেদন আজ বুধবার বিবিএস অডিটরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবেন।

এটি সরকারের চতুর্থ অর্থনৈতিক শুমারি। এর আগে ২০১৩ সালে তৃতীয় এবং ২০০৩ সালে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শুমারি করা হয়। চতুর্থবারের শুমারিতে প্রথম ট্যাবের মাধ্যমে ক্যাপি পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শুমারিতে সারা দেশকে ১৩টি ভাগে ভাগ করে ৯০ হাজার গণনাকারী অংশ নেন। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আঞ্চলিক বৈষম্য, আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবসা ও শিল্পায়নে ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে।

বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে জিডিপির আকার ছিল ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। ১০ বছরে সেই আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের হার ধরে শিল্প খাতে বছরের পর বছর ধরে দেখানো জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই হিসাব মিলছে না অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রাথমিক হিসাবের সঙ্গে। গত ১৩ বছরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের (প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৫.৩৯ শতাংশ। অথচ ২০০১-০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত শুমারির তুলনায় ২০১৩ সালের শুমারিতে এ খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বেড়েছিল ১০০.৪২ শতাংশ।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সার্বিকভাবে দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের প্রবৃদ্ধি কমেছে। বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টিতে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এ হিসাবে ১৩ বছরে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৯টি বা ৫১.৯১ শতাংশ বেড়েছে। এর আগের জরিপে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪১ লাখ ১০ হাজার ৪২১টি বেড়েছিল, যা ২০০৩ সালের ৩৭ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৪টি ইউনিটের তুলনায় ১১০.৮৫ শতাংশ বেশি।

ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি হওয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিটে এ খাতের অবদান ৮.৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অংশ ছিল ১২.১৪ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ১১.৫৪ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ টানা দুই শুমারিতে কমেছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রতিষ্ঠানের অংশ।

গত ১৩ বছরে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২ থেকে ৫৬.৬৮ শতাংশ বেড়ে ১ কোটি ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৬টিতে দাঁড়িয়েছে। ফলে মোট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেবা খাত ৮৮.৮৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১.২৩ শতাংশে।

এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এবিসিসিআই) সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জাম হোসেন বলেন, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি বেসরকারি খাত। গত ৪-৫ বছর এ খাতের অবস্থা খুবই খারাপ। করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে বিনিয়োগ ৭০ শতাংশ কমেছে। সুতরাং অর্থনীতি যে সঠিক অবস্থায় চলছে না, তার প্রমাণ উঠে এসেছে। তিনি বলেন, বিগত সময়ে উন্নয়ন ও এফডিআইয়ের ফুলঝুরি ছড়ানো হলেও বাস্তবে কোনো এফডিআই আসেনি। এ অবস্থা চললে দেশ ও অর্থনীতি বড় ক্ষতির দিকে এগিয়ে যাবে। এ জন্য প্রয়োজন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুদহার কমানো, শিল্পের কাঁচামালের দাম কমানোর উদ্যোগ।

স্থায়ী-অস্থায়ী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখানো হয়েছে ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ২১৪টি। অস্থায়ী ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টি এবং পারিবারিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান দেখানো হয়েছে ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টি। অথচ ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দেখানো হয়েছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে স্থায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৪৫ লাখ ১৪ হাজার ৯১টি, অস্থায়ী ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৩ এবং পারিবারিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫৭১টি।

অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৮৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৬১টি, শহরাঞ্চলে ৩৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৩টি। ২০১৩ সালে গ্রামাঞ্চলে ছিল ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার ১৯টি এবং শহরাঞ্চলে ২২ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৬টি।

বিভাগওয়ারি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকায় ৩২ লাখ ৯ হাজার ৫৫০, চট্টগ্রামে ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫১, রাজশাহীতে ১৬ লাখ ৯২ হাজার ৬০৪, খুলনায় ১৫ লাখ ১৮ হাজার ১৩৪, বরিশালে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩৬, রংপুরে ১৩ লাখ ৬১ হাজার ৪২৩, ময়মনসিংহে ৭ লাখ ৯১ হাজার ৬৩২ এবং সিলেটে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩৪টি।

কর্মসংস্থান বেড়েছে ৬২ লাখ ৬০ হাজার: শুমারির প্রাক্-প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩ কোটি ৭ লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জন কর্মরত। এর মধ্যে পুরুষ ২ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ২৯৮ এবং মহিলা ৫১ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৭ জন। এ ছাড়া হিজড়ার সংখ্যা ২ হাজার ৫৯ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে ই-কর্মাস খাতে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৭৮টি প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫৫ হাজার ৪৭৪, চট্টগ্রামে ২২ হাজার ৪২, খুলনায় ১০ হাজার ৪৩২, রাজশাহীতে ৮ হাজার ৬৯০, রংপুরে ৭ হাজার ৮৩৭, সিলেটে ৪ হাজার ৯৭৮ এবং বরিশালে ৪ হাজার ৫৬টি।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আজকের পত্রিকাকে বলেন, জিডিপির আকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ইউনিট বেড়েছে, এটি ইতিবাচক। কিন্তু অর্থনীতির আকারের সঙ্গে শিল্পের আকার সেভাবে বাড়েনি। অর্থনীতির আকারের সঙ্গে শিল্পায়ন না হওয়ার পেছনে সরকারের প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা রয়েছে, তা দূর করতে হবে। নীতি-কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। তিনি বলেন, অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের নীতি-কাঠামো পর্যালোচনা করে গতানুগতিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, টেকসই উন্নয়নে এগিয়ে যেতে হবে।