Image description

চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে এবার আলোচনায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবির। উভয় সংগঠনের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতির চেহারা কেমন হবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে প্রভাব বিস্তার নিয়ে কোথাও কোথাও অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে দেখা গেছে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। পরস্পরবিরোধী মন্তব্য নিয়ে উত্তেজনা ও কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠেছিল তার বাস্তবায়ন কতদূর, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতি আবারও পুরোনো চেহারায় নাকি নতুন রূপে ফিরবে—সেটি নিয়েও শিক্ষার্থীদের কৌতূহল এবং আলোচনা আছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আসে ছাত্রশিবির। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্রশিবির দ্রুততম সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায়।

তাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তারা বেশি ভোট পাবে। অন্যদিকে ছাত্রদলের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চান না। কেননা, তাদের অনেক নেতা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে সক্রিয় না থাকায় তারা নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এসব নিয়ে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের মধ্যে নীরব দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারিকে ছাত্রলীগ বলা নিয়ে উভয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য ছাত্রদল ও শিবিরের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তাদের বক্তব্য এবং সম্পর্ক কেবলই রাজনৈতিক সম্পর্কের। আর আগামীতে ছাত্ররাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, গত শনিবার রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় পুলিশ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের হট্টগোল হয়। মূলত জবি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানেরই সম্প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একটি ছবি নিয়ে দ্বন্দ্ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ছবি পাওয়া যায়। পুলিশ আয়োজিত নাগরিক সভায় জবি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি রিয়াজুল ইসলাম ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি জসিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। সভায় রিয়াজুলের একটি ছবি দেখিয়ে ছাত্রলীগ বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর এক পর্যায়ে হট্টগোলের সৃষ্টি হলে পুলিশ রিয়াজুলকে ওসির অফিসে বসতে বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। পরে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা থানায় আসতে শুরু করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ মীমাংসা করে দেয়। যে ছবি নিয়ে এই হট্টগোলের সূত্রপাত সে বিষয়ে রিয়াজুলের যুক্তি, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম এবং বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছি। ফেব্রুয়ারিতে একুশের চেতনার একটা আয়োজনে ছাত্রলীগের নাম না থাকায় আমাদের গণিত বিভাগের একটি রুমে তিন ঘণ্টা আটকে রাখে। পরে মার্চ মাসের আরেকটি বড় প্রোগ্রামে ছাত্রলীগকে দাওয়াত না দিয়ে প্রোগ্রাম করতে পারছি না। যার কারণে আমরা বাধ্য হয়ে দাওয়াত দেওয়া হয় এবং সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রুমে সভাপতি ও সেক্রেটারির সঙ্গে একটা ছবি তোলা হয় এবং ফেসবুকে প্রচার করা হয় যেন অনুষ্ঠানটি সফল হয়।’

সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা রিয়াজুলের শিবির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানতাম না। তার একটা ছবি আমাদের কাছে ছিল। জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির সঙ্গে দাঁড়ানো। আমরা যাচাই না করেই তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করি। পরে বাগবিতণ্ডা হয়। তবে তাকে আটকে রাখার অভিযোগ মিথ্যা। জবি ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা না বলে এমন ঘটনা তৈরি হওয়া ঠিক হয়নি। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’ এদিকে গত রোববার শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জবি ছাত্রশিবির সেক্রেটারির সঙ্গে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে সেটি খুবই দুঃখজনক। যা ভবিষ্যতে ছাত্রসংগঠনগুলোর ঐক্যের পথকে সংকুচিত করে দিতে পারে। এর আগে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) একটি ছাত্রসংগঠনের একজন কর্মী নিজ বিভাগের কয়েকজনকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করে ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে। যদিও বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ায় তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। গত শনিবার গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিভাজন সৃষ্টিকারী কিছু বক্তব্য দিয়েছে। এ অবস্থায় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সকলের কাছে আন্তরিক, বন্ধুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করি।

জানা যায়, এর আগে তিন সদস্যের আংশিক কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে আসার পর গত ১৯ নভেম্বর ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক সর্বদলীয় মতবিনিময় সভায় অংশ নেয় ছাত্রশিবির। সভা শুরুর কিছুক্ষণ পরই ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে হট্টগোল শুরু হয়। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে প্রথম আপত্তি তোলা হয়। পরে কয়েকটি বাম সংগঠনও এতে যোগ দেয়। আবার ছাত্রশিবিরের পক্ষেও বক্তব্য রাখে কয়েকটি সংগঠন। পক্ষে-বিপক্ষে, পাল্টা-পাল্টি স্লোগানে একপর্যায়ে বৈঠক পণ্ড হয়ে যায়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রশিবির আত্মপ্রকাশ করার পর সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছিল ছাত্রদলকে। ছাত্রদল কেন শিবিরবিরোধী? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিনের সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আহ্বানে অংশ নেওয়া ছাত্রদল নেতা রিফাত মাহমুদ বলেছেন যে, শিবির এই ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত। ২২টা ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন তাদের নিষিদ্ধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগও আছে। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা বলেছি যে তাদের সঙ্গে থাকব না। তখন আমরা ওয়াকআউট করি, সেখান থেকে চলে আসি। শিবিরকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে সবার আগে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। তারা গুপ্ত রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসুক আগে। তাদের অবস্থান ও কর্মসূচি আমাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। তারপর ছাত্রসংগঠনগুলো, সাধারণ ছাত্র এবং প্রশাসন বিবেচনা করবে তাদের রাজনীতি এখানে চলবে কি চলবে না। তবে শিবির ইস্যুতে সাময়িক উত্তেজনা থাকলেও জাহাঙ্গীরনগরে মোটাদাগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘুরে সেখানে শিবিরের নেতাকর্মীদের অবস্থানও দেখা গেছে।

অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল সক্রিয় থাকলেও দীর্ঘদিন সংগঠনটির কমিটি ছিল না। অতঃপর গত ৮ জানুয়ারি ১৭৭ সদস্যের কমিটি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেশ সক্রিয় আছে বাম সংগঠনগুলোও। অন্যদিকে ছাত্রশিবিরও চেষ্টা করছে পূর্ণ সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে হাজির হতে। কিন্তু বিরোধিতার মুখে সেটা কতটা সম্ভব? শিবির-ছাত্রদল কি মুখোমুখি হচ্ছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে আসায় বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল কয়েকটি বাম সংগঠন। পরে ছাত্রদলও নানা প্রশ্ন তুলেছে এটা নিয়ে। এই ইস্যুতে দুই দলের কর্মী-সমর্থকদেরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দিতে দেখা যায়।

গত বছরের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ উপলক্ষে বিএনপির দলীয় পোস্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে সাঁটিয়ে দেয় ছাত্রদল। তবে হলগুলোতে পোস্টার লাগানোর পর ছাত্রদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলে রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল হয় সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে। কার্যক্রমের শুরুতেই এমন বিরোধিতা বেশ বেকায়দায় ফেলে ছাত্রদলকে। ছাত্রদল এর পেছনে শিবিরকে দায়ী করলেও শিবির অবশ্য সেটা অস্বীকার করেছে। তবে এমন পরিস্থিতি শুধু ঢাকায় নয়, আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও দেখা যায়। বিশেষ করে চট্টগ্রামে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির সংঘর্ষ কিংবা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে খবর ছড়িয়েছে। ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে যায় সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যদিও ছাত্রদল-শিবির মুখোমুখি অবস্থানে নেই বলে দাবি দুদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। তাহলে বিরোধিতা কেন তৈরি হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির অভিযোগের সুরে বলেন, ৫ আগস্টের পরে শিবির বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আংশিক আত্মপ্রকাশ করেছে। এরপরই ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে প্রোপাগান্ডা তৈরি করছে। বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থী সেজে শিবিরের গোপন অংশ আমাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়েছে, মব তৈরি করেছে। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ঠিক এরকম চেষ্টাই তারা করেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। বরং ছাত্রশিবির অনেক উদারতা দেখাচ্ছে। আমরা কোনোক্রমেই কারও মুখোমুখি নই। আমাদের কার্যক্রম তো সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।