Image description

শেখ হাসিনা সরকারের কেনা ইসরাইলি নজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহার করে কোনো কোনো বিদেশী এজেন্সি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়ি পেতে নিয়ে গেছে বলে চাঞ্চল্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি সরকারের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো খতিয়ে দেখছে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে একের পর এক তথ্য ফাঁস, নজরদারির অভিযোগ এবং বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সম্ভাব্য কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় গোয়েন্দা মূল্যায়ন সেলের একটি অভ্যন্তরীণ ব্রিফিং থেকে শুরু করে টেলিকম সেক্টরের সাইবার মনিটরিং ডেটা- সব কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশের নিরাপত্তা পরিমণ্ডল এখন একটি সংবেদনশীল ক্রস-রোডে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন উঠছে- আড়ি পাতা কি নিরাপত্তার প্রয়োজনে বৈধ সহযোগিতা, নাকি এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষয়ের আরেকটি অধ্যায়?

বাংলাদেশে নাগরিক নজরদারি- বরাবরই বিতর্কিত ছিল। তবে বিগত সরকার আমলে গোপনে সংগৃহীত আড়ি পাতার যন্ত্রপাতি, এর উৎস, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী চক্র এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ‘গোপন ব্যবহারে’ কী পরিমাণ প্রযুক্তি ও টাকা খরচ হয়েছে- তা নিয়ে এখন যে তথ্য বেরিয়ে আসছে, সেটি কেবল একটি নীতি বিতর্ক নয়; বরং বাংলাদেশে বিদেশী গোয়েন্দা প্রযুক্তির নীরব অনুপ্রবেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা খাতের গোপন বাণিজ্যিকীকরণের ভয়াবহ চিত্র।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর প্রেস সচিব শফিকুল আলম যেভাবে বললেন- ‘অনেক কিছুই ইসরাইল থেকে কেনা হয়েছে’ এটি কেবল একটি বাক্য নয়; বরং এক দশকব্যাপী একটি অন্ধকার নেটওয়ার্কের প্রথম সরকারি স্বীকারোক্তি।

গোপন চুক্তির উৎস : কে কত নিয়েছে, কে কত দিয়েছে- সব অজানা

এরই মধ্যে সরকারিভাবে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটির প্রধান হলেন- প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তারাই খতিয়ে দেখবেন কোন সংস্থা কত টাকায় কোন প্রযুক্তি কিনেছে, দালাল বা মধ্যস্থতাকারী কারা, সরকারি অনুমোদন ছিল কী না, যন্ত্রগুলো ব্যবহার হয়েছে নাগরিকের বিরুদ্ধে, নাকি অন্য উদ্দেশ্যে এবং এই প্রযুক্তি নাগরিকের ডেটা কোথায় পাঠিয়েছে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- কেন বাংলাদেশ গোপনে ইসরাইলি নিরাপত্তা প্রযুক্তি কিনল, যখন দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এই সিদ্ধান্ত কি রাজনৈতিক? নাকি গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরের কোনো স্বার্থচক্রের অংশ?

৩০০ মিলিয়ন ডলারের ‘শান্ত’ পাইপলাইন : কে চালাচ্ছিল এই বাজার?

প্রেস সচিবের ভাষ্যমতে, দুই ধরনের রিপোর্ট রয়েছে : ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্য আর ৩০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্য। অর্থাৎ ২১০০ থেকে ৩২০০ কোটি টাকার একটি ছায়া-বাজেট গিয়েছিল আড়ি পাতা, স্পাইওয়্যার, ট্র্যাকিং ভ্যান, ডেটা ইন্টারসেপশন ডিভাইস, ডিপ-প্যাকেট ইন্সপেকশন সিস্টেম ও সাইবার নজরদারি সফটওয়্যার কেনায়।

এখন পর্যন্ত পাওয়া নথি বলছে- এই অর্থের বড় একটি অংশ গিয়েছে: ১. সাইপ্রাস-ভিত্তিক প্যাসিটোরা (আগে উইস্পিয়ার), ২. সুইজারল্যান্ডের তরু গ্রুপ, ৩. ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান সেলেব্রাইট ও ৪. ইসলামী ডিফেন্স ফোর্স আইডিএফ-এর সাবেক গোয়েন্দাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান-পিকসিক্স এ।

এই বাজারের সাথে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশী দালাল, বিদেশে অবস্থানরত মধ্যস্বত্বভোগী, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়/ক্রয় কমিটির কিছু রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

তদন্তকারীরা বলেছেন- এই বাজারে ওঠানামা করেছে অবৈধ কমিশন, বিদেশী সফর, ব্যক্তিগত চুক্তি, এবং টেন্ডারের বাইরে ‘বিশেষ অনুমোদনে’ ক্রয়।

ভয়ঙ্কর স্পিয়ারহেড ভ্যান : স্পিয়ারহেড ভ্যান হলো বাংলাদেশের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একটি মোবাইল ‘ডিজিটাল কারাগার’: ইসরাইলি পত্রিকা হারেৎজ-এর বিস্ফোরক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ এনটিএমসির জন্য ৫৭ লাখ ডলার ব্যয়ে যেটি কিনেছে- তা কেবল একটি ভ্যান নয়; এটি একটি মোবাইল হ্যাকিং আর্মি।

ভ্যানটি আধা কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ফোন কল, এসএমএস, কন্টাক্ট লিস্ট ও ডেটা ফোল্ডার - সব কিছু রিয়েল-টাইমে সংগ্রহ করতে পারে।

এনক্রিপ্টেড অ্যাপও এর নজরদারি থেকে নিরাপদ নয়। ভ্যান থেকে ফোনে স্পাইওয়্যার ইনস্টল করা যায়- ব্যবহারকারী বুঝতেই পারে না। এমনকি আশপাশের ল্যাপটপ/কম্পিউটারেও প্রবেশ করতে পারে।

অর্থাৎ কোনো মিছিল, সমাবেশ, শিক্ষক আন্দোলন, সাংবাদিকতা বা বিরোধী দলের কোনো গোপন বৈঠক- সবই কার্যত ব্ল্যাক বক্সে বন্দী হয়ে যেতো।

বিগত সরকারের সময় এই ভ্যান কোথায় ব্যবহার হয়েছে? কার বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে? এগুলোর ডেটা কোথায় গেছে? এসব কিছু জানার জন্য তদন্ত কমিটি বলছে- তারা ব্যবহারের লগ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তবে সূত্র বলছে- লগের অনেক অংশই মুছে ফেলা হয়েছে।

গোপন সফর, গোপন প্রশিক্ষণ : গ্রিস, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ডে রহস্যময় ভ্রমণ : হারেৎজ আরো জানায়- ২০২১ ও ২০২২ সালে এনটিএমসির কর্মকর্তাদের গ্রিস ও সাইপ্রাসে পাঠানো হয়েছিল এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিতে। এই সফরে কারা গিয়েছেন? এই সফরের খরচ কে দিয়েছে? এই সফরের ব্যাকডোর চুক্তি কী ছিল? -এসব প্রশ্নও তদন্তের আওতায় এসেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অস্বীকার নাকি কূটনৈতিক কৌশল?

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও এনটিএমসির মহাপরিচালক বলেছেন- বাংলাদেশ সরাসরি ইসরাইল থেকে কিছু কেনেনি। প্রযুক্তির রুট ছিল : ইসরাইল থেকে সাইপ্রাস থেকে সুইজারল্যান্ড/মধ্যস্থতাকারী সেখান থেকে বাংলাদেশ।

অর্থাৎ তারা সরাসরি উৎস নয়- মধ্যস্থতাকারীর পেছনে ইসরাইলি প্রযুক্তি লুকানো ছিল কি না, সেটিও ছিল পূর্ব পরিকল্পনার অংশ। তদন্তকারীরা বলছেন- এই ধরনের ‘ডিনায়েবিলিটি’ গোয়েন্দা প্রযুক্তি বাণিজ্যে সাধারণ কৌশল।

জাতীয় নিরাপত্তা নাকি ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নজরদারি?

প্রাথমিক তথ্য বলছে- এই আড়ি পাতার মূল টার্গেট ছিল : বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক, শ্রমিক নেতা, কয়েকটি মিডিয়া হাউজের সাংবাদিক, সরকারের ভেতর ‘অবিশ্বস্ত’ আমলা, শক্তিশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ অফিস।

অর্থাৎ প্রযুক্তি কেনা হয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে কিন্তু এর ব্যবহার হয়েছিল রাজনৈতিক বিরোধ দমন, ভিন্নমত নিয়ন্ত্রণ, এবং ক্ষমতাকে ‘ডিজিটাল লৌহদেয়ালে’ রাখার জন্য।

সবচেয়ে বড় ঝুঁকি : বাংলাদেশের নাগরিকের তথ্য বিদেশে গেছে কী না?

বহু বিশেষজ্ঞ বলছেন- ইন্টেলেক্সা অ্যালায়েন্স (যার অংশ প্যাসিটোরা) এবং সেলেব্রাইটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকায় অভিযোগ রয়েছে : ক্লায়েন্ট দেশের ডেটা সার্ভারে ব্যাকডোর রাখা, বিদেশী সংস্থার সাথে মেটাডেটা শেয়ার, এনক্রিপশন ভেঙে ডেটা কপি করে নেয়া।

বাংলাদেশে আনা প্রযুক্তিগুলোতে এই ধরনের ব্যাকডোর ছিল কী না- এটিও তদন্তের প্রধান ফোকাস। যদি ব্যাকডোর থাকে- তা হলে গত এক দশকে বাংলাদেশের সাংবাদিক, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সেনা কর্মকর্তা, ছাত্রনেতা- সবার ব্যক্তিগত তথ্য বিদেশী সার্ভারে গিয়ে থাকতে পারে। এটি জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

আড়ি পাতার তদন্ত বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল সত্য কমিশন’ তৈরির সূচনা : ইসরাইলি প্রযুক্তি ক্রয়-সংক্রান্ত তদন্ত এখন কেবল প্রশাসনিক নয়; এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর গভীরতম স্তরে জমে থাকা গোপন নজরদারি রাষ্ট্রের রোগ উন্মোচন করার পথ খুলে দিচ্ছে।

গোটা চক্র উন্মোচিত হলে বেরিয়ে আসতে পারে : রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মন্ত্রিসভার ভূমিকা, গোপন বাজেটের অপব্যবহার, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে অঘোষিত নেটওয়ার্ক, নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরের বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সূত্রপথ।

দেশের নাগরিকদের এখন অপেক্ষা- এই তদন্ত কি সত্যিই সম্পূর্ণ উন্মুক্তভাবে হবে, নাকি কিছু বড় নামকে রক্ষা করতে আবারো প্রক্রিয়াটি অন্ধকারে ঢেকে ফেলা হবে।

গুরুত্বপূর্ণ ৩টি ঘটনার উৎসে বিতর্ক

১. টেলিকম অপারেটরদের ‘ডিপ প্যাকেট ইনস্পেকশন’ ডেটা ফাঁস

সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের তিন বড় টেলিকম অপারেটরের নেটওয়ার্ক অ্যানালিটিক্সে অস্বাভাবিকভাবে বিদেশী আইপি ব্লক থেকে নিয়মিত ‘ডিপ স্ক্যানিং’ কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন- এটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির সম্ভাব্য ইঙ্গিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিপিআইভিত্তিক নজরদারি সাধারণত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অপারেশনের অংশ, যেখানে টার্গেট করা হয়- ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেল, মন্ত্রণালয়গুলোর ইমেইল সার্ভার, আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত এনক্রিপ্টেড প্যাকেট, মিডিয়া হাউজ ও রাজনৈতিক সংগঠনের যোগাযোগ।

২. কূটনৈতিক চ্যানেলে ‘কমিউনিকেশন ইন্টারসেপ্ট’ অভিযোগ

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে কিছু দূতাবাস সম্প্রতি তাদের এনক্রিপ্টেড কমিউনিকেশনে অবৈধ স্নুপিংয়ের চেষ্টা সম্পর্কিত ‘নোট ভার্বাল’ পাঠিয়েছে। যদিও কোনো দেশ সরাসরি কাউকে অভিযুক্ত করেনি, অভ্যন্তরীণ গোপন বৈঠকে দুইটি বড় শক্তির নাম উঠে এসেছে- একটি পশ্চিমা, একটি আঞ্চলিক।

এ ধরনের নজরদারি সাধারণত তিনটি উদ্দেশ্যে করা হয়:

১. সরকারের অভ্যন্তরীণ অবস্থান বোঝা, ২. নীতি-পরিবর্তনের পূর্বাভাস সংগ্রহ, ৩. কৌশলগত আলোচনায় এজ বা লিভারেজ লাভ।

৩. নিরাপত্তা সংস্থার অভ্যন্তরীণ বিভাজন

বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যেই বিদেশী এজেন্সির সাথে সহযোগিতা বনাম প্রতিরোধ নিয়ে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে।

একটি গ্রুপ যুক্তি দিচ্ছে, গ্লোবাল কাউন্টারটেররিজম নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা প্রয়োজন;

অন্য গ্রুপ মনে করে, এটি ‘ব্যাকডোর’ খুলে দেয়, যেখান দিয়ে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্রের নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।

এই টানাপড়েনের মধ্যেই আড়ি পাতার অভিযোগ আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।

দুই দশকের পুরনো ছায়াযুদ্ধ : বাংলাদেশ কেন টার্গেট?

বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘স্ট্র্যাটেজিক স্পাই করিডর’ বলা হয় তিনটি কারণে :

১. ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান : ভারত-চীন প্রতিযোগিতা, বঙ্গোপসাগরীয় সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও মিয়ানমার সঙ্কট- সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক গোয়েন্দা আগ্রহের মূল কেন্দ্র।

২. আর্থিক ও সাইবার সেক্টরের দুর্বলতা : বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর থেকেই আন্তর্জাতিক সাইবার গোয়েন্দা নেটওয়ার্কগুলো বাংলাদেশকে ‘সফট টার্গেট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। দেশীয় সাইবার প্রতিরক্ষা, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে, এখনো বিচ্ছিন্ন ও অস্বচ্ছ।

৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ইতিহাস : বহুজাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাজনৈতিক ট্রানজিশন-সংবেদনশীল দেশগুলোতে বেশি সক্রিয় থাকে। ২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং বিভিন্ন শক্তির পুনঃসমীকরণ বিদেশী নজরদারি বৃদ্ধি করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিদেশী এজেন্সির প্রভাব : ৩টি ঝুঁকি

১. নীতিনির্ধারণে অদৃশ্য চাপ : নিরাপত্তা চুক্তি, সামরিক ক্রয়, বন্দর ব্যবহারের অনুমতি, পানিবণ্টন আলোচনা- এসব সংবেদনশীল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশী শক্তির ‘ইনটেলিজেন্স-ড্রাইভেন’ প্রভাব খাটানোর আশঙ্কা বাড়ছে।

২. রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রভাব খোঁজা : ইতিহাস বলছে, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাধারণ আগ্রহ থাকে- বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ অবস্থান, নির্বাচনী কৌশল ও রাজনৈতিক জোটের বিন্যাস। এই তথ্যগুলো তারা নানা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে।

৩. অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ভঙ্গুরতা : স্মার্ট গ্রিড, ডিজিটাল পেমেন্ট, বন্দর অটোমেশন- এসব সিস্টেমের ব্যাকডোর তৈরি করা গেলে একটি দেশের অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে ‘ম্যানিপুলেট’ করা যায়। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এটিকেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন।

সরকারি অবস্থান ও বাস্তবতা

সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে- ‘বাংলাদেশে কোনো বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাকে অবৈধভাবে আড়ি পাতা বা সাইবার অপারেশন করার অনুমতি নেই।’

তবে বাস্তবে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার-

১. টেলিকম সেক্টরে বিদেশী প্রযুক্তিভিত্তিক মনিটরিংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল;

২. অনেক নিরাপত্তা প্রকল্পেই বিদেশী কনসালট্যান্টদের গভীর অ্যাক্সেস থাকে;

৩. সাইবার ফরেনসিক ল্যাবগুলোর একটি অংশ বিদেশী অনুদানের ওপর নির্ভরশীল।

ফলে ‘ইনস্টিটিউশনাল গেটওয়ে’ থেকেই আড়ি পাতার সুযোগ তৈরি হয়।

বিভিন্ন দেশের ভূমিকার চিত্র : যদিও কোনো দেশের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি, ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে-

মার্কিন নেটওয়ার্ক সাধারণত সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার আড়ালে ডেটা ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করে;

ভারতীয় নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা, রাজনীতি ও সীমান্ত-সম্পর্কিত আলোচনায় গভীর আগ্রহী;

চীনা সাইবার ইউনিট অর্থনৈতিক প্রকল্প, প্রযুক্তিগত প্রবেশাধিকার ও লজিস্টিকস ইন্টেলিজেন্সে মনোযোগী;

মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর গতিবিধি বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায়।

বাংলাদেশ এই চারটি প্রবাহের মাঝখানে অবস্থান করছে।

জনগণের গোপনীয়তা : সবচেয়ে উপেক্ষিত ক্ষেত্র

বিদেশী এজেন্সির আড়ি পাতা নিয়ে বিতর্কে সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় হলো সাধারণ নাগরিকের তথ্য সুরক্ষা। এর মধ্যে রয়েছে- এনআইডি ডেটাবেইস, পাসপোর্ট-ইমিগ্রেশন তথ্য, মোবাইল কল লিস্ট ও ফেসবুক-মেসেঞ্জার ব্যাকআপ।

এসব সিস্টেমে যেকোনো বিদেশী অ্যাক্সেস দীর্ঘমেয়াদে জনগণের নাগরিক স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক।

আড়ি পাতার লড়াই শুধু গোয়েন্দা খাতে নয়, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে : বিদেশী এজেন্সির আড়ি পাতা নিয়ে বিতর্ক কেবল প্রযুক্তিগত বা গোয়েন্দা ইস্যু নয়- এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত সিদ্ধান্ত, রাজনীতি এবং নাগরিক স্বাধীনতার ওপর একযোগে আঘাত। যারা মনে করেন এটি একটি অতিরঞ্জিত আশঙ্কা, তারা হয়তো দেখছেন না- বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এখন আর সরাসরি নীতি চাপায় না; তারা ডেটা দিয়ে প্রভাব তৈরি করে, তথ্য দিয়ে ন্যারেটিভ গড়ে, আর গোপন নজরদারির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বদলায়।

কী করা উচিত?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন কর্তৃপক্ষের কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যার মধ্যে রয়েছে- সাইবার সোভরেইন্টি অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে বিদেশী সাইবার অবকাঠামো অ্যাক্সেস সীমিতকরণ; টেলিকম সেক্টরের সম্পূর্ণ অডিট করে ডিপিআই, এলআই : (আইনসম্মত আড়ি পাতা) সিস্টেমের বিদেশী সংযোগ চিহ্নিতকরণ; ডিপ্লোম্যাটিক কমিউনিকেশনের স্বতন্ত্র এনক্রিপশন লেয়ার; স্বাধীন সাইবার কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নজরদারি এবং ফিন্যান্সিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সাইবার ব্যাকডোর রিভিউ করা- বিশেষত ব্যাংকিং সেক্টরে।

আড়ি পাতার লড়াই শুধু নিরাপত্তা ইস্যু নয়- এটি ক্ষমতার শীর্ষ স্তরের পুনর্গঠন : বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আড়িপাতা এখন আর শুধু টেলিফোন শোনা নয়; এটি নীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি, অর্থনৈতিক অবকাঠামো ম্যাপ করা, বন্দর ও কৌশলগত সম্পদে ভবিষ্যৎ প্রবেশাধিকার তৈরির খেলা।

বাংলাদেশ বর্তমানে সেই গেমবোর্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই লড়াইয়ে যে রাষ্ট্র তার ডেটা রক্ষা করতে পারবে- শুধু সেই রাষ্ট্রই ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণে স্বাধীন থাকবে।