Image description
► মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে গুলি ► নেওয়া হয়েছে এভারকেয়ারে ► সারা দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ

ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে প্রকাশ্যে গুলি করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল বেলা ২টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রাত ৮টার দিকে শরিফ ওসমান হাদিকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, হাদির মাথার ভিতর গুলি ঢুকে বেরিয়ে গেছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাদিকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে। ন্যক্কারজনক এই ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি করেছেন। এ ঘটনায় গোটা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নয়াপল্টনের বায়তুল ফালাই জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে এক সহযোগীকে নিয়ে হাই কোর্টের দিকে অটোরিকশায় করে যাচ্ছিলেন ওসমান হাদি। বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডের ‘ডিআর টাওয়ার’ পার হওয়ামাত্রই খুব কাছ থেকে মোটরসাইকেলে করে আসা দুর্বৃত্তরা হাদিকে লক্ষ্য করে পরপর দুটি গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। রিকশায় লুটিয়ে পড়েন হাদি। এ সময় গুলির বিকট শব্দে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জুমার নামাজ শেষে বাসায় ফিরতে থাকা মুসল্লিরা এগিয়ে আসেন হাদির সহযোগীদের গগনবিদারী চিৎকারে। গুরুতর অবস্থায় হাদিকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে। এ ঘটনার পর হাসপাতাল এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী অবস্থান নেয়।

ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, শরিফ ওসমান হাদির মাথায় সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। অস্ত্রোপচারে মাথার ভিতর কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। আগেই গুলি মাথায় ঢুকে বেরিয়ে যায়। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, গতকাল দুপুরে জুমার নামাজের আগপর্যন্ত সর্বশেষ মতিঝিল ওয়াপদা মাদ্রাসা এলাকায় (জামেয়া দারুল উলুম) নির্বাচনি জনসংযোগ করেছিলেন ওসমান হাদি।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, গতকাল বেলা ২টা ২৪ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে একটি মোটরসাইকেলে দুই হেলমেটধারী দুর্বৃত্ত রিকশায় থাকা হাদির পিছু নেয়। ডিআর টাওয়ার পার হওয়ার পরপরই ২টা ২৪ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে খুব কাছ থেকে গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায় তারা। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির পেছনের রিকশায় ছিলেন মো. রাফি। তিনি ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন।

মো. রাফি বলেন, ‘জুমার নামাজ শেষে আমরা হাই কোর্টের দিকে আসছিলাম। পেছনের রিকশায় ছিলাম। বিজয়নগরে আসতেই একটা মোটরসাইকেলে করে দুজন এসে হাদি ভাইয়ের ওপর গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়।’ ওসমান হাদির সঙ্গে থাকা মিসবাহ নামের আরেকজনও একই দৃশ্যের বর্ণনা দেন। ঘটনার পরপরই পুলিশ ও সিআইডি সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে তদন্ত শুরু করেন। এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানের পাশ থেকে দুইটি গুলির খোসা উদ্ধার করে সিআইডি। গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে খোসাগুলো জব্দ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সংস্থাটি।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, উদ্ধার করা খোসা পরীক্ষা করে অস্ত্রের ধরন ও গুলির উৎস শনাক্তের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী বলেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা সন্ত্রাসীদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই লুকিয়ে থাকুক তাদের খুঁজে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা-র‌্যাবসহ সবাই কাজ করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। বেলা ২টা ২৫ মিনিটে একটি মোটরসাইকেলে দুর্বৃত্তরা আসে। মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়।’

র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফাইজুল আরেফিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে অনেকগুলো সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে কাজ করছি। আরও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ চলছে।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, দুপুরে মতিঝিল ওয়াপদা মাদ্রাসা (জামিআ দারুল উলুম মতিঝিল) এলাকায় হাদির সঙ্গেই মাস্ক পরা অবস্থায় জনসংযোগে অংশ নিয়েছিলেন দুই যুবক। তাদের একজনের গায়ে কালো পাঞ্জাবি, কালো মাস্ক, গলায় চাদর এবং পরনে আকাশি রঙের জিনস প্যান্ট ছিল। অন্যজনের গায়ে ছিল কালো ব্লেজার, কালো মাস্ক, চোখে চশমা, পায়ে চামড়া রঙের জুতা। পরবর্তী সময়ে বাইক থেকে গুলি ছোড়া দুই ব্যক্তিরও গায়ে একই ধরনের পোশাক ছিল। সরেজমিনে গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে কালভার্ট রোডের মুখে ডিআর টাওয়ারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতের পাশেই ১৫-২০ ফুট এলাকাজুড়ে রক্তের দাগ স্পষ্ট। আর সেই রক্তাক্ত স্থান ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ পথচারীদের ভিড় ছিল। পরিস্থিতি ছিল থমথমে।

ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ র‌্যাব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া ডিআর ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনছেন। এর কিছু সময় পর ঘটনাস্থলে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইমসিন ইউনিট। তারা পুরো ঘটনাস্থল ক্রাইমসিন ঘোষণা করে চিহ্নিত ম্যাপ করে দেয়। পরে বিকাল ৪টার দিকে র‌্যাবের একটি দল পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।

এ সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম ও মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ।

ডিআর টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী গোলাম রাব্বী বলেন, ‘রিকশার চাকা বিস্ফোরণের মতো শব্দ শুনে ভিতর থেকে বের হয়ে আসি। এ সময় দেখি রিকশায় একজন রক্তাক্ত অবস্থায় বসে রয়েছে। তাকে দুই-তিনজন ধরে চিৎকার করছে। আর তাদের পাশ দিয়ে একটি কালো রঙের মোটরসাইকেলে দুইজন দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়। ওই রিকশায় তাকে দ্রুত হাসাপাতালে নিয়ে যায় তার সঙ্গে লোকজন।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় দেখা যায়, ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিতরে গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে যান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, ছাত্রদল নেতা আবিদুল ইসলাম প্রমুখ।

প্রাণনাশের হুমকিতে ছিলেন হাদি : বেশ কিছু দিন থেকেই প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। গত ১৪ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে শরিফ ওসমান হাদি দাবি করেছিলেন, তাঁকে হত্যা ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংস হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ১৪ নভেম্বর নিজের হত্যার হুমকি নিয়ে দীর্ঘ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন শরিফ ওসমান হাদি। সেখানে তিনি লিখেন, ‘গত তিন ঘণ্টায় আমার নম্বরে আওয়ামী লীগের খুনিরা অন্তত ৩০টা বিদেশি নম্বর থেকে কল ও টেক্সট করেছে। যার সামারি হলো, আমাকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তারা আমার বাড়িতে আগুন দেবে। আমার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণ করবে এবং আমাকে হত্যা করবে। ১৭ তারিখ খুনি হাসিনার রায় হবে। ১৪০০ শহীদের রক্তের ঋণ মেটাতে কেবল আমার বাড়িঘর না, যদি আমাকেও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ইনসাফের এ লড়াই হতে আমি একচুলও নড়ব না, ইনশাআল্লাহ। এক আবরারকে হত্যার মধ্য দিয়ে হাজারো আবরার জন্মেছে এ দেশে। এক হাদিকে হত্যা করা হলে তাওহীদের এ জমিনে আল্লাহ লক্ষ হাদি তৈরি করে দিবেন। স্বাধীনতার এ ক্রুদ্ধ স্বরকে কোনোদিন রুদ্ধ করা যাবে না। লড়াইয়ের ময়দানে আমি আমার আল্লাহর কাছে আরও সাহস ও শক্তি চাই। আরশ ওয়ালার কাছে আমি হাসিমুখে শহীদি মৃত্যু চাই। আমার পরিবার ও আমার কলিজার সহযোদ্ধাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কুদরতি কদমে সোপর্দ করলাম। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে। হাসবিয়াল্লাহ।’

যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন : ওসমান হাদির ওপর এমন ন্যক্কারজনক হামলায় দুর্বৃত্তদের দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইলেকশন ওয়াকিং অ্যালায়েন্স, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ (এনআরসি)।

খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগর উত্তরের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় উত্তরার আজমপুরে। খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি অধ্যাপক মাওলানা সাইফ উদ্দিন আহমদ খন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহাবুদ্দিন আহমদ খন্দকার।