
তথ্যটা হলো, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআইয়ের ইন্টারনেট ক্রাইম কমপ্লেইন সেন্টার (আইসিথ্রি) প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি অভিযোগ পেয়েছিল।
ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সে বছর সাইবার অপরাধে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে মানুষের। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দুই-ই ছিল।
কিছু লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে আপনার ফোনটি হ্যাক হয়েছে কি না। হ্যাকারদের চোখে আমাদের ফোন তথ্যের একটি দারুণ ভান্ডার। মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা কোম্পানি ব্লকসেফ টেকনোলজিস এবং স্ট্রাইকফোর্স টেকনোলজিসের সিইও জর্জ ওয়ালার বলেন, ‘যদি কেউ আপনার ফোন হ্যাক করে, তাহলে কয়েকটি তথ্য হ্যাকারের নাগালে চলে যাবে। যেমন ই-মেইল অ্যাড্রেস এবং ফোন নম্বর, ছবি, ভিডিও, গুরুত্বপূর্ণ নথি ও টেক্সট মেসেজ।’
জর্জ ওয়ালার সতর্ক করে বলেন, ‘ফোনের কি–বোর্ডে আপনি কোন কি চাপলেন, হ্যাকাররা তা-ও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এর মানে পাসওয়ার্ড, ব্যক্তিগত তথ্য, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, ব্যাংকের তথ্য, পাশাপাশি যেকোনো করপোরেট তথ্য চুরি করতে সক্ষম।’
ব্যাপারটা যতটা ভয়ংকর ও বিপজ্জনক শোনাচ্ছে, আদতে ততটাই ভয়ংকর। নিজের জীবন, সম্পদ এবং আরও অনেক কিছু রক্ষা করার জন্য আপনার এ বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
ফোন হ্যাক হওয়ার কয়েকটি লক্ষণ
ব্যাটারির চার্জ দ্রুত শেষ হয়ে যায়
যত চার্জই দিন না কেন, ফোনের ব্যাটারির চার্জ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে? অন্য কোনো কাজে ফোনের ব্যবহার স্বাভাবিক থাকার পরও এমন হলে আপনার ফোনটি হ্যাক হয়ে থাকতে পারে। ফোনের ম্যালওয়্যার সারাক্ষণই সক্রিয় থাকে। তাই এতে প্রচুর চার্জ ব্যয় হয়। ক্রমাগত আপনার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যেতে থাকলে এটি ফোন হ্যাক হওয়ার লক্ষণ।
ফোনটা গরম হয়ে যায়
ব্যবহার না করলেও ফোন গরম হয়ে থাকে? এটিও ফোন হ্যাক হওয়ার লক্ষণ। ইন্টারনেট ডেটা স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি ব্যবহৃত হতে থাকলে সারাক্ষণই ফোনটা গরম হতে থাকবে।
সব মিলিয়ে ফোনটা ভালোভাবে কাজ করে না
ফোন করা, ফোন ধরা, মেসেজ পাঠানো, ভয়েস মেসেজ চেক করা, এসবে খুব বেশি সময় লাগে না। এসব সাধারণ কাজ করতেও যদি ফোনটি বেশি সময় নেয়, তাহলে এটিও ফোন হ্যাক হওয়ার লক্ষণ। অনেক সময় দেখা যায়, একটি ওয়েবপেজ ব্রাউজ করতে করতে হঠাৎই হারিয়ে গেল বা ক্রাশ করল। এ অবস্থায় ফোনটি রিস্টার্ট করার চেষ্টা করতে হবে। ফোনে কোনো ম্যালওয়্যার থাকলে ফোনটি সহজে কিংবা মোটেও রিস্টার্ট করা যায় না।
ডেটা ইউজেজ হঠাৎ বেড়ে গেছে
নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপ ব্যবহার করে আপনার ফোনের ডেটা ইউজেজ পর্যবেক্ষণ করুন। আপনার ফোনে ব্যবহৃত ডেটার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখা গেলে বিষয়টি সন্দেহজনক। কারণ, ম্যালওয়্যারগুলো প্রচুর ডেটা খরচ করে।
আপনার অজান্তেই ফোন থেকে কল ও মেসেজ চলে যায়
এ রকম কিছু দেখলে বুঝতে হবে হ্যাকাররা আপনার ফোনটি ইচ্ছেমতো নম্বরে ফোন করছে বা মেসেজ পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া স্প্যামের মতো একের পর এক পপ-আপ আসতেই থাকে। একের পর এক পপ-আপ আসার অর্থ হলো ফোনটিতে অ্যাডওয়্যারের অস্তিত্ব আছে।
পর্দায় নিত্যনতুন অ্যাপ উদয় হয়
ফোনে কি এমন কোনো অ্যাপ আছে, যা আপনি ডাউনলোড করেননি? থাকলে এখনই আনইনস্টটল করুন। কোন কোন অ্যাপ ব্যাটারি বেশি খরচ করছে, তা-ও খেয়াল করুন। যেসব অ্যাপ অতিরিক্ত ব্যাটারি নষ্ট করে সেসব সাধারণত অ্যাপের ছদ্মবেশে ম্যালওয়্যার। এসব অ্যাপের মাধ্যমে হ্যাকাররা আপনার ফোনে নজরদারি করে।

আপনার অ্যাকাউন্টগুলোতে অস্বাভাবিক কার্যক্রম
আপনার ই–মেইল আইডি নতুন কোনো ডিভাইস থেকে অ্যাকসেস করার চেষ্টা করলে আপনার কাছে একটি ই–মেইল আসে। তাই ই–মেইলের ইনবক্স সব সময় চেক করুন। নতুন ডিভাইস থেকে লগইন, পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে কোনো নোটিফিকেশন ইত্যাদি আপনার অজান্তেই আসতে থাকলে বুঝতে হবে কেউ আপনার আইডিগুলো হ্যাক করতে চাইছে।
সিগন্যাল চলে যায়
এটি খুবই ভয়াবহ। আপনার মোবাইল অপারেটর থেকে হয়তো একটি টেক্সট মেসেজ বা ই–মেইল নোটিফিকেশন পেলেন। এর আধা ঘণ্টা পর রিবুট করা সত্ত্বেও আপনার মুঠোফোনে কোনো সিগন্যাল না এলে বিষয়টি সন্দেহজনক।
এ রকম হলে আপনি আপনার ই–মেইল অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবেন না এবং আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লক হয়ে যাবে। এটি ‘নম্বর পোর্টিং অ্যাটাক’ নামে পরিচিত। আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলো এভাবে হ্যাক করা হয়।
যা করলে আপনার ফোন হ্যাক হতে পারে
আজেবাজে লিংকে ক্লিক করা
‘অমুকের গোপন ভিডিও ফাঁস’—এমন শিরোনাম দেখে ভুলেও কোনো লিংকে ক্লিক করবেন না। অনেক সময় হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপেও দেখা যায় আপনার কোনো আপনজনের কাছ থেকেই মেসেজ আসে কোনো একটি লিংকে ক্লিক করার জন্য। ওসব লিংকে ক্লিক করামাত্রই আপনার ফোনে ট্রোজান ভাইরাস (একধরনের ম্যালওয়্যার) ঢুকে যাবে এবং আপনার ফোনে থাকা সব তথ্য সাইবার অপরাধীরা চুরি করতে পারবে।
পাবলিক চার্জিং স্টেশন ব্যবহার করা
হ্যাকাররা পাবলিক চার্জিং স্টেশন এবং পাবলিক ইউএসবি কেবলের আড়ালেও মিনি কম্পিউটার ও ম্যালওয়্যার লুকিয়ে রাখে। তাই ফোন চার্জ দিতে পাবলিক চার্জিং স্টেশন ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ বাস বা রেলস্টেশন, শপিং মল, কোনো আয়োজনস্থলে ফোন চার্জ না করাই উত্তম।
ক্ষতিকর অ্যাপ ডাউনলোড করা
মোবাইল গেমের মতো একটি নিরীহ অ্যাপও হতে পারে আপনার মুঠোফোন হ্যাক হওয়ার কারণ। সাইবার অপরাধীরা প্রায়ই বৈধ অ্যাপের আড়ালে ম্যালওয়্যার ও স্পাইওয়্যার ছড়ায়।
চাকরির অফার পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়া
আজকাল অনলাইনে চাকরি দেওয়া এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেও ফোনে ‘ফিশিং অ্যাপ’ ইনস্টল করে কিছু গোষ্ঠী তথ্য চুরি করে। তাই অনলাইনে কাজের অফার পেয়েই যাচাই–বাছাই ছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়বেন না।
জনসমাগমস্থলে ফোন রেখে যাওয়া
এমনকি বাসায়ও যখন অনেক লোকজন থাকে তখনো ফোন নিজের হাতছাড়া করা ঠিক নয়। মার্কিন সাইবার নিরাপত্তা রক্ষাকারী কোম্পানি ম্যাকাফির চিফ কনজিউমার সিকিউরিটি ইভানজেলিস্ট গ্যারি ডেভিসের মতে, ‘অনলাইনের ঝুঁকিগুলো নিয়ে অনেকেই সচেতন। কিন্তু ঝুঁকি বাস্তব জীবনেও থাকতে পারে। আপনার চোখের অলক্ষ্যেই ফোনটি হ্যাক করতে পারে আপনারই পরিচিত কেউ।’

এক পাসওয়ার্ড সবখানে ব্যবহার করা
বিশেষজ্ঞদের মতে, একই পাসওয়ার্ড সব ওয়েবসাইট বা অ্যাপে ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একই পাসওয়ার্ড হয়তো আপনি ফেসবুক, গুগল, অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে আপনার মুঠোফোন—সবখানেই ব্যবহার করছেন। হ্যাকার ঢুকল আপনার ফেসবুক আইডি হ্যাক করার জন্য। একই পাসওয়ার্ড সবখানে ব্যবহার করলে হ্যাকার আপনার ফোন পর্যন্ত হ্যাক করে ফেলতে পারবে। তাই পাসওয়ার্ডের ব্যাপারে আলসেমি করা যাবে না। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
পাবলিক ওয়াই–ফাই ব্যবহার করা
রেস্তোরাঁ বা হোটেলের মতো জায়গায় ফ্রি ওয়াই–ফাই পেয়ে হয়তো আপনি বেজায় খুশি। কিন্তু এই ফ্রি ওয়াই–ফাই হতে পারে আপনার সর্বনাশের কারণ। ফ্রি ওয়াই–ফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আপনার ফোনে নজরদারি করা সহজ। ফ্রি ওয়াই–ফাই যদি ব্যবহার করতেই হয় তাহলে ভিপিএন ব্যবহার করুন। যদি ভিপিএন ব্যবহার না-ই করতে চান, তাহলে ফ্রি ওয়াই–ফাই ব্যবহার করে কখনো ব্যাংকিং করবেন না।
ফ্রি ওয়াই–ফাই ব্যবহার করে আপনার ই–মেইলও চেক করবেন না। একেবারেই নিরুপায় হলে অ্যাড্রেস বারের দিকে লক্ষ রাখুন। ওয়েবসাইট অ্যাড্রেসটি কি সঠিক? ওয়েবসাইটে http://–এর পরিবর্তে https:// লেখা উচিত; কারণ, এই অতিরিক্ত ‘s’ নিরাপদ কানেকশনের জন্য জরুরি। URL–এর পাশে একটি সবুজ লক চিহ্নও থাকা উচিত। নিরাপদ কানেকশনের এই নির্দেশকগুলো দেখতে না পেলে আপনার লগইন তথ্য লিখবেন না।
ফোন হ্যাক হলে করণীয়
ফোন হ্যাক হয়েছে সন্দেহ হলে আতঙ্কিত হবেন না। ব্যাপক ক্ষতি রোধ করার জন্য আপনার অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিছু পরামর্শ মেনে চলুন—
পাসওয়ার্ড পরিবর্তন
গুরুত্বপূর্ণ পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন। তবে সব সময় এটি কার্যকর হয় না। হ্যাকাররা আপনার নতুন পাসওয়ার্ডও বের করে ফেলতে পারে।
মাল্টি–ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন চালু করুন
এটা সবারই করা উচিত। অনেক জনপ্রিয় অ্যাপ এবং পরিষেবা এটির অনুমতি দেয় (ফেসবুক, গুগল এবং শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যাংক)। এটি চালু থাকলে হ্যাকাররা আপনার বেশি ক্ষতি করতে পারে না।
ডিভাইস রিস্টোর
আপনার ডিভাইস রিস্টোর করুন। এ প্রক্রিয়ায় আপনার ডিভাইসটি থেকে সব তথ্য মুছে ফেলুন। তারপর ক্লাউড স্টোরেজ থেকে আপনার তথ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কাজটি একটু কঠিন। তবে আজকাল আগের চেয়ে সহজে ডিভাইস রিস্টোর করা যায়।
এ ছাড়া আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ওয়ালেট এবং ক্রেডিট কার্ডগুলো সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখতে পেলে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। অতি দ্রুত আপনার অ্যাকাউন্ট লক করার নির্দেশ দিন।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট