
পরিবার কিংবা ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকার সময় হঠাৎই ফোনে খুদেবার্তা বা এসএমএস আসে। জরুরি কোনো বার্তা কি না দেখতে গেলে, দেখা যায়-এসএমএসটি এসেছে অপরিচিত নম্বর থেকে। তাতে লেখা, ঘরে বসে আয় করতে চাইলে ভিজিট করুন এই ঠিকানায়।
মাঝেমধ্যেই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা মাহফুজ সালেকীন বর্ষণ। তিনি ক্ষুদ্র পরিসরে ট্রাভেল এজেন্সি গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। মাহফুজ বলেন, এসব খুদেবার্তায় লিংক দেওয়া থাকে। ক্লিক করলে অচেনা ওয়েবসাইটে নিয়ে যাবে। যে নম্বর থেকে বার্তাটি আসে সেটি অচেনা। তারা কারা কিংবা কীভাবে নম্বর পেয়েছে সেটি জানার উপায় থাকে না।
মাহফুজ সালেকীন বলেন, বিভিন্ন সময় কেনাকাটা করতে গেলে বিক্রেতারা মোবাইল নম্বর চান। সব সময় এর কারণ জানতে ইচ্ছে করে না। পরে দেখা যায় এমন কিছু নম্বর বা কোম্পানি থেকে বিজ্ঞাপনের এসএমএস আসে যেগুলোর সঙ্গে কখনো যোগাযোগই হয়নি।
গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা নিয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলাদেশে সংবিধানের তৃতীয়ভাগে জনসাধারণের যোগাযোগের মাধ্যমের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের কথা আছে। রহিত হওয়া ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো ব্যক্তিকে না জানিয়ে তাঁর তথ্য সংগ্রহ কিংবা তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা অপরাধ হিসেবে উল্লেখ ছিল।
দেশে বিভিন্ন সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় আলাদা নীতিমালা করার দাবি জানিয়েছে ‘বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন। এর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, মোবাইল নম্বরও ব্যক্তিগত তথ্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে সংবিধানই হলো সর্বোচ্চ আইন। সেখানে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকারের কথা থাকলেও এর প্রয়োগ দেখা যায় না।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তাদের সংগঠনে পরিচিত অনেকেই অভিযোগ দেন। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এসএমএস আসে। নানা বিষয়ে আলাপের এক পর্যায়ে কিছু ব্যক্তিগত তথ্য বিনিময় করেন ওই শিক্ষার্থী। অপরপাশ থেকে এক সময় সেই বার্তার স্ক্রিনশট নিয়ে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। এখানে প্রশ্ন হলো ওই শিক্ষার্থীর ফোন নম্বর অপরিচিত ব্যক্তি পেল কীভাবে? শুধু দোকান নয়, বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাকের মাধ্যমেও ব্যক্তির ফোন নম্বর তৃতীয় পক্ষের কাছে যাচ্ছে।
ভারতে আইনের খসড়া হওয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আনন্দবাজার বলছে, বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, পোশাক ও ওষুধের নামী দোকানগুলো ক্রেতাদের কাছে মোবাইল নম্বর চায়। কখনও অনলাইনে রশিদ দেওয়ার জন্য, আবার কখনও ‘লয়্যালটি পয়েন্ট’ এর জন্য নম্বর চাওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোকানের কর্মীরা বিল দেওয়ার ক্যাশ কাউন্টারে ক্রেতাদের কাছে মৌখিকভাবে তা চান। ক্রেতাদেরও তা মৌখিকভাবেই জানাতে হয়, যা দোকানের কর্মী থেকে শুরু করে আশপাশের লোকেরাও শুনতে পায়। এভাবে মোবাইল ফোন নম্বর চাওয়ার ফলে ক্রেতার ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এমন ঘটনার উদাহরণ দিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু চেইনশপে গ্রাহককে ফোন নম্বর দিতে অনেক সময় বাধ্য করা হয়। পণ্যের দাম পরিশোধের সময় মেম্বারশিপ নম্বর চাওয়া হয়। ওই আইডি নম্বর দিলে একটি সিস্টেমে বিল এন্ট্রি করা হয়। কারও আইডি নম্বর না থাকলে ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে আইডি খুলে দেওয়া হয়। এরপর গ্রাহক লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। তাকে কেনাকাটার রসিদ দেওয়া হয়।
ভারতের একটি আইনি সংস্থার সাইবার সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ের প্রধান এস চন্দ্রশেখর টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, ক্রেতাদের কোনও তথ্য কেন নেওয়া হচ্ছে, কতদিনের জন্য নেওয়া হচ্ছে এবং কবে মুছে ফেলা (ডিলিট) হবে- নতুন আইন অনুসারে তা অবশ্যই ক্রেতাদের জানিয়ে রাখতে হবে। এই তথ্য জানাতে ক্রেতার সম্মতি আছে বলে ধরে নেওয়া যাবে না।
ভারতে ‘ব্যক্তিগত ডিজিটাল ডেটা সুরক্ষা’ নামের আইনটি চালু হলে মৌখিকভাবে আর ক্রেতাদের মুঠোফোন নম্বর চাইতে পারবে না কোনও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা অন্য দোকানগুলো। আনন্দবাজার ও টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ২০২৩ সালে এ সংক্রান্ত বিল সংসদে পাস হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে আইনে পরিণত হয়। কিন্তু গত দুই বছরে তা কার্যকর হয়নি। সবশেষ গত জানুয়ারিতে এই আইনের খসড়া বিধি প্রকাশ করা হয়। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আইনটি কার্যকর করার সুবিধার্থে বিধিমালা-২০২৫ এর খসড়া প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিল, ‘যদি কোনো ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে অপর কোনো ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডের কথা উল্লেখ ছিল। ব্যাখ্যায় ‘পরিচিতি তথ্য’ বলতে বোঝানো হয়েছিল একক বা যৌথভাবে কোনো ব্যক্তি বা সিস্টেমকে শনাক্ত করে এমন বাহ্যিক, জৈবিক, শারীরিক বা অন্য কোনো তথ্য।
২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত বা বাতিল করা হয়েছে। মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডেটা প্রাইভেসি অ্যাক্ট করার দাবি জানিয়েছেন তারা। বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়বকেও জানিয়েছেন। ডেটা প্রাইভেসি অ্যাক্ট খসড়ার পর্যায়ে আছে। এটি চূড়ান্ত হলে বিস্তারিত জানা যাবে।
কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে অভিযোগ জানানোর উপায় বলে দিয়েছে সরকারের ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার। এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে অভিযোগ করতে হবে নিকটস্থ থানায়। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) নামে ফেসবুক পেজে মেসেজ দিয়েও অভিযোগ জানানো যাবে। ইমেইল করা যাবে [email protected] কিংবা [email protected] এই দুই ঠিকানায়। পুলিশ সদর দপ্তরের মোবাইল নম্বরে (০১৩২০০০০৮৮৮) কল করেও অভিযোগ জানানো যাবে। হটলাইন নম্বর ৯৯৯-এ কল করেও অভিযোগ করা যাবে।