
‘এই তো আপার কাছ থেকে আসলাম।’ ‘আপা ফোন করেছিলেন। কালকেই যেতে বললেন’-এভাবেই বিভিন্ন সময়ে নিজেকে জাহির করতেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। তার এই ‘আপা’ ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের শেষদিকে বাফুফের সভাপতি হয়ে শেখ হাসিনার পতনের পরও গদি দখলে রেখেছিলেন সালাউদ্দিন। শুধু শেখ হাসিনাই নন, সালাউদ্দিনের দহরম-মহরম ছিল শেখ রেহানার ছেলে ববি সিদ্দিকীর সঙ্গেও। ববি সিদ্দিকীর আশ্রয়-প্রশ্রয়েই ফুটবলাঙ্গন তথা ক্রীড়াঙ্গনে একজন দানবে পরিণত হয়েছিলেন সালাউদ্দিন। গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর টেলিফোনে তার খোঁজখবর রাখতেন সালাউদ্দিন। এখন আর টেলিফোনে নয়, শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন তিনি।
ক্রীড়াঙ্গনে ফ্যাসিস্টের দুই দোসরের মধ্যে বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন পালিয়ে গেলেও রয়ে যান কাজী সালাউদ্দিন। ৫ আগস্টের পর সালাউদ্দিন দেশ ছেড়ে যাওয়ার নানা উপায় খুঁজছিলেন। সেই সুযোগ পেয়েও গেছেন। সোমবার (১৩ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সালাউদ্দিন ও তার সহযোগী বাফুফের সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরনের বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর কয়েক দফা বিদেশে যাতায়াত করেছিলেন সালাউদ্দিন। তার বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের হওয়ার পর বৈধভাবে বাংলাদেশের সীমান্ত পেরোনো সালাউদ্দিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সেই নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্য বহুভাবে চেষ্টা করেন তিনি। মৃতপ্রায় সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সভাপতি পদক ব্যবহার করে দেশ ছাড়তে চান তিনি। তার এই আশা পূরণে ভেতরে ভেতরে তার জন্য কে লবিং-তদবির করেছেন তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিতে রয়েছে। তার পক্ষে বিশেষ চিঠি দুটি কয়েকটি টেবিল ঘুরে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতামত চাওয়া হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, দুদক থেকে জানানো হয়েছিল কাজী সালাউদ্দিনের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান। এসবি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি গোলাম রসুল হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় যুগান্তরকে জানান, ‘কাজী সালাউদ্দিনের বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে আবেদন করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসবির মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছে।’
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা আমলের পুরোটা সময় অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে ব্যস্ত ছিলেন সালাউদ্দিন-কিরনরা। স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও কমিশন বাণিজ্যে নিমজ্জিত ছিল বাফুফে। সালাউদ্দিন ও মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান কিরনসহ গুটিকয়েক কর্মকর্তার কারণে দেশের ফুটবল সুনাম হারিয়েছে। সালাউদ্দিনের দেড় যুগের নানা অনিয়মে দেশের ফুটবল হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। আর্থিক অনিয়মের কারণে বাফুফের বেতনভোগী সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে চার বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে ফিফা। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীকে প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। জাতীয় দলের সাবেক দুই প্রখ্যাত ফুটবলার শামসুল আলম মঞ্জু ও প্রয়াত বাদল রায় বাফুফের অনিয়ম তুলে ধরে ফিফার কাছে অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ ও ২ এপ্রিল শামসুল আলম মঞ্জুর স্বাক্ষর করা দুটি অভিযোগ ফিফার সভাপতি এবং এএফসির সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ওই অভিযোগের সঙ্গে ৩৮০ পৃষ্ঠার বাফুফের অনিয়মের বিভিন্ন নথি পাঠিয়েছিলেন মঞ্জু।
বাফুফের ব্যাপক দুর্নীতি ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা সংবলিত গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ফুটবলের রুগ্ণ অবস্থার জন্য সালাউদ্দিনই দায়ী। তার চারিত্রিক দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতায় বাংলাদেশের জরিমানা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের প্রাইজমানি ও বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ সরাসরি সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়া করার নামে দুর্নীতি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পরিবারের নাম ভাঙিয়ে ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টের টিকিট দুর্নীতি, সালাউদ্দিন ও কিরনের যৌথ দুর্নীতি, সভার কার্যবিবরণী নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি, বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম, সিলেট বিকেএসপি ক্যাম্পাসে ফুটবল একাডেমির নামে দুর্নীতি, ফিফা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরসংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক আস্ফালন উলেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্টের টেলিকাস্টিং যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ দুই লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ভুয়া খরচ দেখিয়ে ভারতীয় একটি কোম্পানির (রিয়েল ইমপেক্ট প্রাইভেট লি.) সহযোগিতায় ওই টাকা আÍসাৎ করে বলে জানা যায়। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এক ক্রীড়া সাংবাদিকও।
বাফুফের টাকায় শেখ পরিবারের সদস্যদের ইউরো ও বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টের টিকিট দেওয়া হতো। ফিফা ও এএফসি থেকে কমদামি টিকিট কিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অঙ্কে সেটি বিক্রি করতেন সালাউদ্দিন-কিরনরা। সালাউদ্দিন ও মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন মিলে একটি দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছিলেন।
ফুটবল একাডেমি করার জন্য সিলেটে বিকেএসপি পেয়েছিল বাফুফে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ করে একাডেমির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিয়েছিল। ফিফাও অনুদান দিয়েছিল ৭ লাখ ডলার। কিন্তু বাফুফের কোনো অডিট রিপোর্টেই একাডেমি পরিচালনার জন্য ফিফার দেওয়া ৭ লাখ ডলারের কথা উলেখ নেই। কয়েক মাস নামকাওয়াস্তে চালিয়ে একাডেমিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাফুফের ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। ফিফা সভাপতির একদিনের খরচ দেখানো হয়েছিল ৯০ লাখ ৯২ হাজার ৭৭৪ টাকা। বাফুফেকে দেওয়া সরকারের ২০ কোটি টাকা গায়েব করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। লংকা-বাংলা ফাইন্যান্সে স্থায়ী আমানত হিসাব করলেও বছর না ঘুরতে সেই স্থায়ী আমানত ভেঙে অর্থ তুলে নিয়েছে বাফুফে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেওয়া ২০ কোটি টাকার পুরোটাই লোপাট করে ফেলে বাফুফে। এ অর্থের কোনো হদিস নেই বাফুফের অডিট রিপোর্টেও।
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য চেয়ে বাফুফের সাবেক সভাপতি সালাউদ্দিনকে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া কিরণ ও বাফুফের সাবেক প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আÍসাতের অভিযোগে ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সেই রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি।
কিরনের এইচএসবিসি ব্যাংক মতিঝিল ব্রাঞ্চে (হিসাব নং ০০১.০৬৪.৭৪০০০১) অনুসন্ধান করলে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২২ বিশ্বকাপের ভেন্যু বিডিংয়ে কাতারকে সমর্থনের বিনিময়ে প্রায় ৫ লাখ ডলার ঘুস নেওয়ার অভিযোগ ছিল সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। সাফ সভাপতি হিসাবে সালাউদ্দিনের প্রভাব রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে স্টেডিয়াম তৈরি করে দেবে স্পেন-এ ধুয়া তুলে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা করেন সালাউদ্দিন। ফুটবল উন্নয়নের নামে রাশিয়ার সঙ্গেও লোকদেখানো চুক্তি করেছিলেন সালাউদ্দিন। পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করেছিলেন সালাউদ্দিনের মেয়ে সারাজিন ও জামাতা এলেক্স। সারাজিনের ভিয়েতনামি কোম্পানি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে সফটওয়্যার সরবরাহ কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সফটওয়্যার সরবরাহ না করেই প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন সারাজিন। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালসংলগ্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণকাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে প্রায় ২৫ কোটি টাকা কমিশন নিয়েছিল সালাউদ্দিন গং। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এএফসির পালটা ফুটবল জোটে যোগ দিয়ে পাঁচ লাখ ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই অর্থ বাফুফেতে জমা হয়নি। ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর বাফুফের এজিএমে কাউন্সিলরদের কণ্ঠরোধ করে এক মিনিটেই ৩৪ কোটি টাকার বাজেট পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন সালাউদ্দিন গং। এ বিষয়ে বাফুফের সভাপতি তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘আমি আর এসব বিষয়ে জড়াতে চাই না। এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলব না।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহফুজা আক্তার কিরন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দিয়েছে। সেটা আমি এখনো হাতে পাইনি।’
‘আপনি নিজে দুদকের মামলার একজন আসামি। কীভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য কাজী সালাউদ্দিনকে যুগান্তরের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু যুগান্তর প্রতিবেদকের ফোন তিনি রিসিভ করেননি।