
সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে এক যুগ আগে। এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশটি তাদের সমুদ্রসীমা থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করলেও বাংলাদেশ কার্যত কিছুই করতে পারেনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের শাসনকালে সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনে পদক্ষেপ গ্রহণ না করে জোর বাড়িয়েছিল কেবল আমদানিতে। ফলে বর্তমান জ্বালানির সংকটকালীন সমুদ্রখাত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সমুদ্রসীমায় মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলেও পরবর্তীতে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। সর্বশেষ দুটি ব্লকে কাজ করা ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি বিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা।
বাংলাদেশে সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৮ সালে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে দুটি ব্লকের কাজ গ্রহণ করে কনোকো ফিলিপস কোম্পানি। তবে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় কোম্পানিটি কাজ ছেড়ে চলে যায়।
এরপর ২০১৪ সালে চারটি ব্লকের মধ্যে দুটি ব্লকে কাজ শুরু করে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি বিদেশ এবং বাকি দুটি ব্লকে কাজ শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস ও সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কোম্পানি। পরবর্তীতে সান্তোস ২০২০ সালে কাজ ছেড়ে চলে যায় এবং আশানুরূপ ফল না আসায় সম্প্রতি ভারতীয় কোম্পানিটির ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করে পেট্রোবাংলা।
এরপর ২০১৬ সালে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পস্কো দাইয়ুর সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। কিন্তু তারাও কাজ ছেড়ে চলে যায়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রসীমায় স্থবির থাকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম। সর্বশেষ আওয়ামী সরকারের আমলে গত বছরের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়, যার শেষ সময়সীমা ছিল সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। কিন্তু কেউই দরপত্র জমা দেয়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগ
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিকে আগ্রহী করতে সর্বশেষ পিএসসি মডেল-২০২৩ বেশ সময় উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল। ওই মডেলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম নির্ধারণ না রেখে জ্বালানি তেলের দামের ১০ শতাংশ ধরা হয়। তেলের দাম বাড়লে গ্যাসের দামও বাড়বে, কমলে এটিও কমবে।
দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ আওয়ামী সরকারের সময় গৃহীত হলেও তা শেষ হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে। আকর্ষণীয় পিএসসি থাকা সত্ত্বেও কেন বিদেশি কোম্পানি আগ্রহ দেখায়নি, তার কারণ হিসেবে উঠে আসে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাস।
তবে, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করছে বলে জানান জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (উন্নয়ন-১) মোর্শেদা ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রক্রিয়া আবার শুরু করতে আমরা কাজ করছি। সর্বশেষ যে দরপত্র আহ্বান করা হয়, তাতে কেউ অংশগ্রহণ কেন করেনি, সেটাও খতিয়ে দেখছি। আমরা মডেল পিএসসি-২০২৩-এ কিছু সংশোধন এনেছি। এছাড়া, স্টেকহোল্ডার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে আলোচনাও করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই আমরা সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনে দরপত্র আহ্বান করতে পারব।’
পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) মো. শোয়েব বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। পিএসসি মডেলেও সংশোধন আনা হয়েছে। চলতি বছর বা পরবর্তী বছরের শুরুতে দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘সমুদ্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’

দেশের সমুদ্রসীমায় মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলেও পরবর্তীতে তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। সর্বশেষ দুটি ব্লকে কাজ করা ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি বিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিগত সরকারের আমলে সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনে কার্যত কোনো সফলতা আসেনি। ফলে দেশীয় খাতে গ্যাসের সংকট মোকাবিলায় ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়, যা বাড়িয়ে তোলে আর্থিক চাপ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমামের মতে, বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি দায়হীন ভাব থাকে, যা পরিহার করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে তাদের অনীহা কাজ করে। তারা ভাবেন পরবর্তী সরকার এসে সে-সব কাজ করবে। কিন্তু তারা যদি কাজের ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখেন, তাহলে পরবর্তী সরকারের জন্য কাজটা করা সহজ হবে। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত, সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাওয়া।’