Image description

সজীব হোসেনের শিশুকন্যা সানজিদা আক্তার সাফরিন আগে থেকে কিছুটা অসুস্থ ছিল। কিন্তু রাতে জ্বর আর বমির সঙ্গে লড়তে গিয়ে দুর্বল হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। আদরের সন্তানের এমন করুণ অবস্থা দেখে দিশেহারা বাবা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে যাওয়ার পর জানতে পারেন তার অবস্থা খুবই খারাপ। ডেঙ্গুতে মেয়ের প্লাটিলেট এক হাজারের নিচে নেমে গেছে, যা ছিল পরিবারের জন্য এক ভয়ানক দুঃসংবাদ।

শুধু সজীবের মেয়ে নয়, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি অনেক রোগীর অবস্থা এমনই। দুটি হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসা শেষে এখন মোটামুটি সুস্থ শিশু সাফরিন। তার প্লাটিলেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজারে। এতে পরিবারে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও এখনও শঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি।

সাফরিনের বাবা সজীব হোসেন জানান, নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ পানির ট্যাংকি এলাকা থেকে তিনি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তার মেয়ে ২৯নং আদর্শ বালক ও বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী। জ্বর, বমি এবং বমির সঙ্গে রক্ত যেত। প্লাটিলেট এক হাজারের নিচে নেমে গিয়েছিল। বর্তমানে ৪২ হাজার প্লাটিলেট রয়েছে।

dhakapost

ডেঙ্গু এখন সর্বজনীন নগর সংকট

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ডেঙ্গুর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। এই দিনে ডেঙ্গুতে রোগীর মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। ১২ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৪ জন। আর জানুয়ারি থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৪১ হাজার ৮৩১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১৭৯ জনের।

মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে গত শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭৩ জন। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন সাত হাজার ৮১২ জন। মারা গেছেন ৯২ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সাত হাজার ২৫২ জন। এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪৬৮ জন

পরিসংখ্যান বলছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২ হাজার ১৭০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ছয় হাজার ৪১২ জন, ঢাকা বিভাগে ছয় হাজার ১০৭ জন, খুলনা বিভাগে দুই হাজার ১৩১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৬৫ জন, রাজশাহী বিভাগে দুই হাজার ৮১৬ জন, রংপুর বিভাগে ২৮১ জন ও সিলেট বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২৩ জন। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ডেঙ্গু আক্রান্ত চার হাজার ৪৭০ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আক্রান্ত ছয় হাজার ৪৫৬ জন।

dhakapost

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের চিত্র

গত রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, এ হাসপাতালে গত শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭৩ জন। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন সাত হাজার ৮১২ জন। মারা গেছেন ৯২ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সাত হাজার ২৫২ জন। এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪৬৮ জন।

এই হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছে গাজীপুর থেকে আসা রিয়া মনি (৮)। পাঁচ দিন ধরে এখানে তার চিকিৎসা চলছে। রিয়া মনির বাবা রুবেল আহমেদ বলেন, ‘প্রথমে জ্বর উঠেছিল। নাপা খাওয়ানোর পর জ্বর কমে যায়। কিন্তু এক সপ্তাহ পর আবারও প্রচণ্ড জ্বর ওঠে। স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে তারা এখানে রেফার্ড করে। পরে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে।’

একই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন মো. সুমন আখন্দ (৪৫)। তিনি রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় থাকেন। গত শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় পেট ব্যথা ও প্রচণ্ড বমি নিয়ে হাসপাতালে আসেন। তার আগে উত্তর বাড্ডার একটি হাসপাতালে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। সুমন জানান, তিন দিন জ্বর ছিল। এখন জ্বর কমলেও বর্তমানে পেটে ব্যথা রয়েছে।

dhakapost

চিকিৎসকদের অভিমত : ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন

ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. এস এম হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে রোগী বাড়ছে। প্রথম দিকে চিকুনগুনিয়া রোগী বেশি ছিল। বিশেষ করে মে, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এখন রোগী তুলনামূলক অনেক বেশি। উপসর্গ গতবারের মতোই আমরা পাচ্ছি। নতুন কোনো উপসর্গ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ রোগীর জ্বর, শরীর ব্যথা, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি— এগুলো খুবই কমন।’

‘যুবকদের মধ্যে একটা অনীহা থাকে। জ্বরকে তারা তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। জ্বর ওঠার পাঁচ-ছয় দিন পরে যখন অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়, তখন হয়তো-বা তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন।’

dhakapost

তিনি আরও বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বেশি রোগী আসছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। আর ঢাকার বাইরে থেকে কিছু রোগী আসছেন। বিশেষ করে বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর— এই অঞ্চল থেকে কিছু রোগী পাচ্ছি। বাকি রোগী বেশির ভাগ ঢাকার ভেতরের, নারায়ণগঞ্জের বেশি।’

ডেঙ্গু নিয়ে পরামর্শ দিয়ে ডা. এস এম হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘এই সিজনটা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা— এই সিম্পটমগুলো যাদের আছে অবশ্যই তাদের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। কারণ, ডেঙ্গু আসলে খুব জটিল রোগও না, আবার খুব ভালো রোগও না। একটু সচেতন থাকলে তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সচেতনতার অভাবেই রোগী মারা যাচ্ছে। জ্বর হলে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।’

dhakapost

গ্রামে ডেঙ্গু বিস্তারের যে কারণ

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জ্বর তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকে। শেষদিকে জ্বর কমে আসে। তবে, রোগীর প্রেশার হঠাৎ করে কমে যায়। আবার অনেকের হঠাৎ হাত, পা, মাথা ও শরীর ব্যথা করে। কেউ কেউ বমি করে। বমির সঙ্গে রক্তও যায়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে অনেকের ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। গ্রামে কারও ডেঙ্গু পজিটিভ এলেই চিকিৎসকরা শহরে রেফার্ড করছেন। ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী ঢাকায় আসছেন বলে জানা গেছে।

কুমিল্লার একটি উপজেলা হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘসময় ধরে বর্ষা গ্রামে ডেঙ্গু বিস্তারের অন্যতম কারণ। বর্ষার কারণে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে আর গ্রামে জীবাণুনাশক ওষুধ স্প্রে ব্যবহার করা হয় না। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এগুলো ব্যবহার করা হয় কিন্তু গ্রামে এসব ব্যবহার হয় না। গ্রামের মানুষের সচেতনতার অভাবও রয়েছে। এসব কারণে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে।

ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে তিনি বলেন, খুব জ্বর আসবে। 104 ডিগ্রি পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রা বাড়বে। শরীরে প্রচুর ব্যথা থাকবে। এসব লক্ষণ দেখে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা উচিত। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে প্লাটিলেট কমে যায়। জ্বরের সঙ্গে বমি হতে পারে। মাথাব্যথা হতে পারে।