Image description

আগুন নেভাতে গিয়ে প্রতি বছর জীবন হারাচ্ছেন একের পর এক ফায়ার সার্ভিসকর্মী। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা কাজ করেন সব সময়। কিন্তু ঘটনাস্থলে কোন ধরনের দ্রব্য ছিল সে সংক্রান্ত তথ্য গোপন বা ভুল তথ্য দেওয়ায় বারবার মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছেন ফায়ার ফাইটাররা। বেশি মৃত্যু বা আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে কেমিক্যাল থাকার তথ্য গোপনের ফাঁদে পড়ে।

আগুন নেভাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৪৯ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। গত দশ বছরে নিহত হয়েছেন ২৪ জন। আর আহত হয়েছেন ৩৮৬ সদস্য। নিহত-আহত ফায়ার ফাইটারদের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। অধিকাংশ মৃত্যুই কেমিক্যাল কারখানার আগুন নেভাতে গিয়ে। কেমিক্যালের আগুন বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ হারাতে হয়েছে এসব ফায়ার ফাইটারদের। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ১৩ জন ফায়ার ফাইটারের মৃত্যু হয় ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায়।

সবশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার টঙ্গীতে একটি রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে দুজন শতাধিক দগ্ধ। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদের মৃত্যু হয়। আরও দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, কোথাও আগুন লাগার পর দ্রুততার সঙ্গে ছুটে যান ফায়ার ফাইটাররা। কিন্তু সেখানে কী জন্য আগুন লাগতে পারে কিংবা আগুন লাগা ভবন/গুদামে কোন ধরনের দ্রব্য আছে তাও জানানো হয় না। তথ্য গোপন করায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটছে। তারা বিস্ফোরণের বিষয়টি আগে থেকে আঁচ করতে পারছেন না। এতে বেশি হতাহত হচ্ছেন ফায়ার ফাইটাররা।

 

‘তথ্য গোপনের ফাঁদে’ বারবার মৃত্যুর মিছিলে ফায়ার ফাইটাররা

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ফায়ার ফাইটার বলছেন, আমরা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ি, জানি এটা মৃত্যুঝুঁকি; কিন্তু যখন আগুনের ধরন, বিস্ফোরক পদার্থ, গ্যাস বা কেমিক্যালের তথ্য গোপন করা হয়, তখন আমাদের কর্মীদের মৃত্যুর মিছিল বাড়ে। এছাড়া ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর উত্তেজিত জনতা দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের ওপর চড়াও হয়। এজন্য বাধ্য হয়ে আগুনের স্থানে ঝুঁকি নিয়ে প্রবেশ করলে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটলে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যু হয়। কিন্তু আগে থেকে স্থানীয়রা জানান না সেখানে কোন ধরনের মালামাল ছিল।

ব্যর্থতার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনলে কেমিক্যাল শুধু ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নয়, সাধারণ একটা মানুষও মারা যাবে না। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, তবে নিরাপত্তার বলয় সঠিক থাকলে মানুষ অন্তত আহত বা নিহত হবে না।- ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রি. জে. (অব.) আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ

অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলছেন, রাষ্ট্রের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর নেভানোর জন্য ছুটে গিয়ে জীবন বাজি রেখে তারা করছেন। কিন্তু আগুন যদি কেমিক্যালের কারণে হয় তবে ফায়ার ফাইটারদের নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে। তবে আগুন লাগা স্থানে কেমিক্যালের উপস্থিতি আছে কি না অথবা দাহ্য পদার্থ রয়েছে কি না- সে সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয় না। এজন্য দেশের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভবনের প্রবেশ মুখে সাইনবোর্ড টানানো দরকার যে সেখানে কোন ধরনের মালামাল রয়েছে।

 

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর, সিভিল ডিফেন্স পরিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধার পরিদপ্তরের সমন্বয়ে বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন ৪৬ জন ফায়ার সার্ভিসকর্মী। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৬৬, ১৯৭১ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনজন ফায়ার সার্ভিসকর্মীর প্রাণহানি হয়।

নিহত এই ৪৯ ফায়ার সার্ভিসকর্মীর মধ্যে ফায়ার ফাইটার রয়েছেন ৩৫ জন, গ্রুপ লিডার সাতজন এবং ড্রাইভার তিনজন। এছাড়া একজন সিনিয়র স্টেশন অফিসার, স্টেশন অফিসার, ডুবুরি ও নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট।

সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ডে। ২০২২ সালের ৪ জুন সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসকর্মী নিহত হন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একসঙ্গে এত সংখ্যক ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া অপারেশনাল কাজে ২০০৮ সালে চারজন এবং ২০০০ সালে তিনজন ফায়ার সার্ভিসকর্মী মারা যান।

‘তথ্য গোপনের ফাঁদে’ বারবার মৃত্যুর মিছিলে ফায়ার ফাইটাররা

১০ বছরে ২৪ জনের মৃত্যু

২০১৫ সালে মৃত্যু হয় একজনের, আহত হন ৩৭ জন ফায়ার ফাইটার। ২০১৬ সালে মৃত্যু হয়নি তবে আহত হন ৭২ জন। ২০১৭ সালে মারা যান দুজন, আহত হন ৪৭ জন। ২০১৮ সালে আহত হন ২৪ জন, মৃত্যু নেই। ২০১৯ সালে একজন মারা যান এবং আহত হন ২৯ জন। ২০২০ সালে ৩৭ জন আহত হন, মারা যান একজন। ২০২১ সালে আহত হন আটজন, মারা যান দুজন। পরের বছর ২০২২ সালে মারা যান ১৩ জন, আহত হন ৪০ জন। ২০২৩ সালে ৫৪ জন আহত হন, মারা যানয় একজন। ২০২৪ সালে ৩৮ জন আহত এবং দুজন মারা যান। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মারা গেছেন একজন, মোট আহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।

আগুন লাগার ঘটনা অথবা অন্য কোনো দুর্বিপাকে ফোন পেলেই যারা ঝড়ের বেগে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যান, যারা আগুনের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে অন্যের জীবন বাঁচান, তাদের জীবনের দাম কতটুকু?

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কথা হয় শতভাগ দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদার মামা অধ্যাপক আলমগীর কবিরের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘প্রায়ই সংবাদ আসে ফায়ারের সদস্যরা আহত-নিহত হচ্ছেন। কিন্তু কমছে না। সরকার ও ফায়ার সার্ভিসের উচিত এদিকে নজর দেওয়া। কারণ, যারা মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় কাজ করেন তারাই যদি হতাহত হয় তাহলে রক্ষা করবে কারা। আমার ভাগনের মতো এমন শতপভাগ দগ্ধ যেন আর কোনো ফায়ার ফাইটার না হয়।’

যে কোনো কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলের তথ্যগত সহযোগিতা ফায়ার সার্ভিসকে করা হয় না। টঙ্গীতে গুদামে কোন ধরনের জিনিস ছিল তা বলার মতো লোক খুঁজে পাইনি আমরা।- ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার

কেমিক্যাল সেফটির বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেমিক্যাল সেফটির বিষয়ে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা দরকার। কেমিক্যাল ব্যবহার করছে এমন প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট স্থান ও এমএসডিএস অনুযায়ী ব্যবহার করার নিয়ম। সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সেফটি কমিটি করা, নিজেদের নিরাপত্তা তৈরি করা এবং সবশেষ বড় দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণে আনবে। এ পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে সেখানে সেফটি কমিটি আদৌ ছিল কি না, শুধু কমিটি গঠন নয়, প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে কি না এবং তাদের সে ধরনের যন্ত্রপাতি আছে কি না তা দেখা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম সাড়াদানকারী হিসেবে তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এবং ব্যর্থতার দায় তাদের নিতে হবে। ব্যর্থতার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও জবাবদিহিতার আওতায় আনলে কেমিক্যাল শুধু ফায়ার সার্ভিসের কর্মী নয়, সাধারণ একটা মানুষও মারা যাবে না। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, তবে নিরাপত্তার বলয় সঠিক থাকলে মানুষ অন্তত আহত বা নিহত হবে না।’

‘তথ্য গোপনের ফাঁদে’ বারবার মৃত্যুর মিছিলে ফায়ার ফাইটাররা

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলের তথ্যগত সহযোগিতা ফায়ার সার্ভিসকে করা হয় না। টঙ্গীতে গুদামে কোন ধরনের জিনিস ছিল তা বলার মতো লোক খুঁজে পাইনি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘অর্থাৎ আগুন লাগা গুদামে কোন ধরনের মালামাল ছিল তা আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ে জানানো হয়নি। এরপর সেখানে পৌঁছে ফায়ার ফাইটাররা অবজারভেশন করছিলেন। এমন সময় উত্তেজিত লোকজন ফায়ার সার্ভিসের ওপর চড়াও হয় এবং দ্রুত আগুন নেভানোর তাগিদ দেন।’

শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘যারা দগ্ধ হয়েছেন তারা মনে করছিলেন সেখানে কেমিক্যালজাতীয় কিছু থাকতে পারে। সে অনুযায়ী আগুন নেভানোর জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন। কিন্তু উত্তেজিত জনতার কারণে ফায়ার ফাইটাররা ভেতরে পরিদর্শন করতে যান। তখন আগুন খুব সামান্য ছিল। এমন সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনজন। স্থানীয়রা চাপ সৃষ্টি করায় গুদামের ভেতর প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন চার ফায়ার ফাইটার। না হলে ডিফেন্সিভভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালানো হতো।’

তিনি বলেন, ‘উত্তেজিত জনতা ফায়ার সার্ভিসকে সময় দিতে চায় না। তারা চায় আগুন যাই হোক দ্রুত ভেতরে গিয়ে নেভান। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে তা টঙ্গীর জনগণ হয়তো এখন বুঝতে পারছেন। কিন্তু বিস্ফোরণ হওয়ার মতো কেমিক্যাল গুদামটিতে ছিল- এমন তথ্য আমাদের কর্মীদের আগে থেকে দিলে এভাবে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হতো না।’

 

 

শাহজাহান শিকদার আরও বলেন, ‘যদি কোনো গুদাম বা কারখানায় কেমিক্যাল থাকে সেখানে মূল প্রবেশপথে নির্দেশনা দেওয়া লাগে। সেখানে লেখা থাকে- ‘এখানে কেমিক্যাল বা দাহ্য বস্তু আছে; জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।’ বিল্ডিং কোড অনুযায়ী এ ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু গার্মেন্টস কারখানা ছাড়া অধিকাংশ কারখানায় এমন নির্দেশনা থাকে না। কারণ বেশিরভাগ কারখানা চোরাই ব্যবসা করে।’