
তীব্র শিক্ষক সংকটে ভুগছে দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানে অর্ধেকের বেশি শুন্য পদ নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। এতে কর্মরত শিক্ষকদের ওপর তৈরি হচ্ছে অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক চাপ। ক্ষেত্রবিশেষ শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন যথাযথ পাঠদান থেকে। স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। ফলে মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়োগ ও পদোন্নতির দীর্ঘসূত্রতার কারণে পদ শূন্য থাকছে। জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতির পরিবর্তে বিদ্যমান জনবল দিয়েই কাজ চালাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে বাড়তি শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হচ্ছে কর্মরত শিক্ষকদের। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রায় আট মাস কোনো পদোন্নতি বোর্ড না বসায় এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। পরে পদোন্নতি হলেও শিক্ষকদের নতুন পদায়ন হয়নি।
বর্তমানে দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদে ২ হাজার ৫৪৪ জন কর্মরত রয়েছেন। অথচ পদ আছে ৫ হাজার ২৪১টি। এ হিসাবে পদ শূন্য রয়েছে ২ হাজার ৬৯৭টি, যা মোট পদের ৫১.৫ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনেক বিষয়ে এমন দেখা গেছে যে, তিনজন শিক্ষক তিনটি করে ক্লাস নিলে সপ্তাহে ৯টি ক্লাস হয়। কিন্তু এর বিপরীতে আছেন একজন। তাকে তো সপ্তাহে তিনটা বা চারটার বেশি ক্লাস দেওয়া যাবে না। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন কম্প্রোমাইজড হচ্ছেন, ওই শিক্ষকেরও মন-মেজাজ ভালো থাকছে না।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চলতি বছরের জুন মাসের একটি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদে ২ হাজার ৫৪৪ জন কর্মরত রয়েছেন। অথচ পদ আছে ৫ হাজার ২৪১টি। এ হিসাবে পদ শূন্য রয়েছে ২ হাজার ৬৯৭টি, যা মোট পদের ৫১.৫ শতাংশ।
এর মধ্যে ৯০০ অধ্যাপক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৩১২ জন, শূন্য পদ ৫৮৮টি। একইভাবে সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদে যথাক্রমে ১ হাজার ৭১০ ও ২ হাজার ৬৩১টি। এর বিপরীতে ৯২০ ও ১৩১২ জন কর্মরত রয়েছেন। যথাক্রমে ৭৯০ ও ১ হাজার ৩১৯টি পদ শূন্য রয়েছে।
মেডিকেলের ক্লিনিক্যাল ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষক তালিকায় দেখা গেছে, ১ হাজার ৭০৩টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৯৪৫ জন। ৭৫৮টি পদই শূন্য। এছাড়া কিউরেটর ও লেকচারারসহ বেসিক সাবজেক্টের ২ হাজার ১৫৫টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৬২৪ জন। পদ শূন্য আছে ৫৩১টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকায় শিক্ষার্থীরা এসব বিষয় পড়তে আগ্রহ দেখান না। ফলে শিক্ষকও তৈরি হয় না।
বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষক সংকট নিরসনে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে গ্রেডভিত্তিক নির্ধারিত হারে প্রণোদনা পাচ্ছেন বেসিক আটটি বিষয়, অর্থাৎ অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফরেনসিক মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজির শিক্ষকরা। বেসিক না হলেও নন-প্র্যাকটিসিং হওয়ার সুবাদে অ্যানেস্থেশিওলজি ও ভাইরোলজি বিষয়ের শিক্ষকরাও পরবর্তীতে এ প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
কিউরেটর ও লেকচারারসহ বেসিক সাবজেক্টের ২ হাজার ১৫৫টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৬২৪ জন। পদ শূন্য আছে ৫৩১টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকায় শিক্ষার্থীরা এসব বিষয় পড়তে আগ্রহ দেখান না। ফলে শিক্ষকও তৈরি হয় না।
চলতি বছরের শুরুতে এসব বিষয়ের শিক্ষকদের প্রণোদনার হার মূল বেতনের শতভাগ দেওয়ার আবেদন করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এটি অনুমোদিত হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে আটকে যায় এ উদ্যোগ। গত জুলাই মাসে ৫০ শতাংশ হারে প্রণোদনার অনুমতি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগ বলছে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এত বড় হারে প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব নয়। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ৭০ শতাংশ প্রণোদনা অনুমোদন হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। তবে এ সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন এখনও জারি হয়নি। এছাড়া বেসিক সাবজেক্টে অধ্যয়নরত সরকারি প্রার্থীদের জন্যও প্রণোদনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মেডিকেলের বিদ্যমান যে পদ, সেটিও স্ট্যান্ডার্ড পদের তুলনায় অনেক কম বলে মনে করেন স্বাস্থ্য শিক্ষার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী আরও পদ তৈরি হতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন ১৫০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন, তখন থেকে অ্যানাটমির অধ্যাপক একজন। কিন্তু এখন তো শিক্ষার্থী ২৫০, বিদেশি আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীসহ মোট সংখ্যা প্রায় ৪০০ জন।
একজন শিক্ষকের পক্ষে ৪০০ শিক্ষার্থীকে পড়ানো সম্ভব না। অর্থাৎ বিদ্যমান যে পদ, সেখানেই তিন জনের জায়গায় একটি পদ তৈরি হয়েছে। আবার দেখা যাচ্ছে, সে পরিমাণ জনবলও নেই। ফলে শূন্য পদ পূরণের পাশাপাশি আমরা স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের বিষয়টি নিয়েও কাজ চলছে। এটি অনুমোদন হলে ভবিষ্যতে স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পদ সৃজন হবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
যদিও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের আরেক পরিচালক বলছেন, শিক্ষক সংকটের কারণে মেডিকেল শিক্ষার মান কোনোভাবেই ব্যাহত হচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, ‘এতে বিদ্যমান শিক্ষকদের কষ্ট হয়, মান সেভাবে কমে না। কারিকুলাম এবং ক্লাস শেষ না করে পরীক্ষা হয়েছে, এমনটি কখনও হয়নি। বেতন কম হওয়া সত্ত্বেও একজন শিক্ষক দ্বিগুণ বা তিন গুণ কাজ করছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীর চাহিদার ঘাটতি রাখা হচ্ছে না। এমনকি ক্যালেন্ডার মেনেই পরীক্ষা হচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষক সংকট মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান ব্যাহত করছে। এ সংকট নিরসনে কাজ চলছে। গত এক-দেড় মাসে বেশ কিছু পদোন্নতি হয়েছে। তবে একটি সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার কারণে এখনও পদায়ন হয়নি।
এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের পছন্দ ও মেধার সমন্বয়ে পদায়ন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যাবে। পদোন্নতি একটি চলমান প্রক্রিয়া, আশা করছি- শিগগিরই শিক্ষক সংকট কেটে যাবে।
মহাপরিচালক বলেন, ‘বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষক সংকট দূর করতে তাদের প্রণোদনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রণোদনার ব্যবস্থা করছি। সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মাসিক ২০ হাজার টাকা প্রণোদনার প্রস্তাব করেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এতে সম্মতি দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন হলে আমরা এটা শুরু করব। এতে শিক্ষার্থীরা বেসিক সাবজেক্টে পড়ার জন্য আগ্রহ পাবে।’