Image description

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন জোবাইদ পুতিয়া। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফেরারি হয়ে যান। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এর মধ্যে কেটে গেছে ১৪ বছরের বেশি সময়। তবু ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি জোবাইদ পুতিয়া পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন নুর মোহাম্মদ। আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। প্রায় দেড় মাস ধরে জেল খাটছেন নুর।

ঘটনাটি ঘটেছে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিষয়টি সম্প্রতি নজরে আসে আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পুলিশের। মাদক মামলার আসামি জোবাইদ পুতিয়া কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়ার মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে। তার স্থলে জেল খাটা নুর মোহাম্মদ টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ফকির আহাম্মদের ছেলে। হাজতের পরোয়ানায় জোবাইদ পুতিয়ার মায়ের নাম শাহজাহান এবং টেকনাফের মৌলভী কাসেমের বাড়ির পাশের বাসিন্দা বলে উল্লেখ রয়েছে। আর নুর মোহাম্মদের মায়ের নাম নুর বেগম এবং ফকির আহাম্মদের বাড়ির বাসিন্দা বলে উল্লেখ আছে।

পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা একটি মামলায় গ্রেফতার হন জোবাইদ পুতিয়া। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১১ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত জেল খেটে জামিনে মুক্ত হন জোবাইদ। এরপর থেকে পালিয়ে আছেন। ২০১৮ সালে মামলাটি নথিভুক্ত করে বিচারকাজ শুরু করেন কুমিল্লার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। কিন্তু দীর্ঘ সময় আসামি পলাতক থাকায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন বিচারক। এরপরও আদালতে হাজির হননি জোবাইদ। পুলিশও তার খোঁজ পাচ্ছিল না।

চলতি বছরের ১২ আগস্ট কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী এএইচএম আবাদের মাধ্যমে জোবাইদ পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এক ব্যক্তি। আগে থেকেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকায় তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

কুমিল্লা কারাগার সূত্র জানায়, ওই ব্যক্তিকে কারাগারে আনার পরদিনই বিপত্তি দেখা দেয়। আগে জেল খাটা জোবাইদ পুতিয়ার ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে অমিল দেখা যায় নতুন করে আসা ব্যক্তির। পরে মামলার এজাহারে থাকা আসামির নাম-ঠিকানা, নথিপত্র ঘেঁটে এবং নতুন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) দেখা যায়, কারাগারে আসা ব্যক্তির নাম নুর মোহাম্মদ। বাবা-মায়ের নাম এবং ঠিকানাও দুজনের ভিন্ন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুমিল্লা কারাগারের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‌‘বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ে ধরা পড়ার পরপরই আমরা কারা অধিদফতর, আদালত এবং পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছি। একইসঙ্গে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে জোবাইদ পুতিয়ার বদলে সাজা খাটতে কারাগারে আসেন নুর মোহাম্মদ। আসামির পক্ষ থেকে তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, জেলে যাওয়ার তিন দিনের মধ্যেই জামিনে কারাগার থেকে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সেটি আর হয়নি।’

এ ব্যাপারে নুর মোহাম্মদের আইনজীবী এএইচএম আবাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেদিন নুর মোহাম্মদ আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসেছিলেন সেদিন বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেছিলেন তিনিই জুবাইদ পুতিয়া। আমি আগে তাকে কখনও দেখিনি। এজন্য এনআইডি চেয়েছিলাম। তখন বলেছিলেন, প্রবাস থেকে এসেছেন। তার কাছে এই মুহূর্তে এনআইডি নেই। পরে দেবেন। এরপর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর পর বিস্তারিত ঘটনা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার দীর্ঘ আইনজীবী ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছে এই ঘটনা। তবে আমার কাছে নুর মোহাম্মদকে নিয়ে এসেছিলেন আমার সহকারী শ্রীমন্ত।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমন্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হয়তো আদালত ভুল বুঝেছেন। নুর মোহাম্মদ ও জুবাইদের নামে ভুল ছিল।’ দুজনের বাবা-মায়ের নামেও কি ভুল ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রীমন্ত বলেন, ‘আসলে সুমন নামের এক পরিচিত লোক নুর মোহাম্মদকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন।’

নুর মোহাম্মদকে কীভাবে ম্যানেজ করা হলো জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘২০১৮ সালের দিকে আমি কারাগারে ছিলাম। ওই সময় আমার সঙ্গে টেকনাফের এক লোকের পরিচয় হয়। গত মাসে টেকনাফের ওই লোক তার এলাকার বাসিন্দা জুবাইদ পুতিয়ার জন্য একজন আইনজীবী খুঁজে দিতে বলেন। তার অনুরোধ রাখতে গিয়ে আইনজীবী খুঁজে দিই।’ তবে টেকনাফের ওই লোক সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি সুমন।  

সার্বিক বিষয়ে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-১-এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারাগারের মধ্যে এসব জালিয়াতি চলতে থাকলে অপরাধের মাত্রা কমার বদলে বেড়ে যাবে। আমরা চাই যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি গত ১৪ আগস্ট জেনেছিলাম। তখনই কারা অধিদফতর, আদালত এবং পুলিশকে জানিয়েছি। এখন এটি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। বিষয়টি নিয়ে আমরা আর কিছু বলতে চাই না। আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।’