Image description
 

আদর্শগত এবং ভোটের রাজনীতিতে পরস্পর বিপরীত মুখী ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এমনকি জামায়াত নেতাদের এবং তাদের আদর্শকে ভ্রান্ত বলে প্রচার করত দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল  পর্যন্ত।
আবার শুরু থেকেই নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় তৈরি করতে চাওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি নিজেদেরকে বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী বলে প্রচার চালিয়েছে।  এমনকি দলের নেতাকর্মীরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক জয় পেয়ে সরকার গঠনেরও স্বপ্ন দেখতেন। দলটির নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে লবিং করে কিছু আসন দাবি করছিল। কিন্তু বিএনপি তাদের পর্যাপ্ত আসন দিতে নারাজ ছিল।
আবার দলটি প্রথম থেকেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রেখেই চলত। এমনকি এনসিপি গঠনের পর শিবিরের কয়েক নেতা দলে যুক্ত হয়নি এনসিপির নেতাদের জামায়াত বিরোধিতার কারণে।
অন্যদিকে এক সময়ের বিএনপির হাতিয়ার এবং পরবর্তীতে বিএনপি জোটের শক্তিশালী অংশীদার কর্নেল অলি আহমদও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে যুক্ত হয়েছেন।
এমনি পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির নয়া মেরুকরণ শুরু হয়েছে। জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটে মোটা দাগে বেশিরভাগ  
দলই হলো ধর্মীয় রাজনৈতিক দল। ফলে এমন জোট রাজনীতিতে এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে কিছুটা হলে চাপে ফেলে দিয়েছে।
আবার এনসিপি থেকে বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতার পদত্যাগের কারণে বিপ্লবের শক্তি বলে পুরো রেজাল্ট পাওয়া বর্তমান এনসিপির পক্ষে অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় আগামী নির্বাচনে ভোটের মাঠে যাদের কৌশল ভালো হবে তাদের জয়লাভ করার পথ সুগম হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে আগামী নির্বাচনে জোট কিংবা প্রতীক নয়, ব্যক্তিই হবে মূল। প্রার্থী ভালো না হলে যে কোনো জোট থেকে জয়লাভ করা কঠিন হবে বলে তারা মনে করেন।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এই ছয়টি দল আসন সমঝোতার ভিত্তিতে সব আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা শুরু করে। পরে এতে যোগ দেয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। জামায়াতসহ এই আটটি দল বিভিন্ন দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে টানা অনেক দিন মাঠে ছিল। নতুন করে এনসিপি ও এলডিপি নির্বাচনী সমঝোতায় যুক্ত হওয়ায় এখানে দলের সঙ্গে সংখ্যা দাঁড়াল ১০টিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জামায়াতের জোটের কারণে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, ভোটের মাঠে প্রতিযোগিতা হবে। তবে বিএনপির দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, জামায়াতের জোটের ফলে রাজনীতিতে এক ধরনের নয়া মেরুকরণ হয়েছে। তবে অতীতেও এমন মেরুকরণের ইতিহাস রয়েছে।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন খুবই প্রতিযোগিতামূলক হবে। এখানে জোট বা দল নয় বরং প্রার্থীর কাজ এবং ব্যক্তিগত ইমেজ হবে নির্ধারক। প্রায় ৩৫ ভাগ তরুণ ভোটার তারা কাকে ভোট  দেবে এটা এখনো অনিশ্চিত। সুতরাং আমি মনে করি,
যে দলে বা জোটে জনপ্রিয় প্রার্থী বেশি সে জোটই নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা বেশি।
এদিকে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পদত্যাগ নতুন জোটকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দেবে বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তারা মনে করেন, এনসিপির মধ্যে যারা প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী এবং জনগণের মধ্যে যারা প্রগতিশীলতাকে লালন করেন তাদের ভোট বিদ্যমান এনসিপির ঘরে আর যাবে না। এতে ইসলামিক জোট থেকে প্রগতিশীল অংশটি বিএনপি জোটের দিকে ধাবিত হবে বলে মনে করেন তারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন, বিএনপি, এই জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ১৭ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল। আর বিএনপির অধীনে জামায়াতের সঙ্গে জোট হয়েছিল। জামায়াতের অধীনে নাম যেখানে এনসিপিকে বলাই হয় জামায়াতের আরেকটা দোকান; তাহলে কেন এনসিপি আগে নিজের স্বকীয়তা, নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াতকে বেছে নিতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছে? তিনজন মন্ত্রী ছিল না ক্ষমতায়? পারেনি তো।
‘জামায়াতের সঙ্গে জোট না চাওয়া মানে বিএনপির সঙ্গে চাওয়া না। আমার রাজনীতিই সংস্কারের পক্ষে। নতুন সংবিধানের পক্ষে। আমি চেয়েছিলাম স্বতন্ত্র একটা নির্বাচন হোক, তৃতীয় জোট করে, বিএনপি/জামায়াতের বাইরে গিয়ে।’
অন্যদিকে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, শেষ মুহূর্তে এসে এমন জোট বিএনপির ভোটের মাঠে কোনো প্রকার প্রভাব ফেলবে না। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং এনসিপি শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গেই ভোটে যাবেন, এটা বিএনপির হাইকমান্ড জানত। ফলে  ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং এনসিপিকে বাদ দিয়েই বিএনপি ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনের মাঠে ধর্মকে ব্যবহার করে ইসলামিক জোট জনগণের ভোট টানার চেষ্টা করবে- এটিও বিএনপি হাইকমান্ড ভালো করেই জানে। বিএনপিও যে কোনোভাবেই ইসলামের বিপক্ষের কোনো দল নয়, সেটাও তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দিবসের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রবিবার ঠাকুরগাঁওয়ে বলেছেন, বিএনপির অঙ্গীকার; কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো আইন আমরা করতে দেব না। কিন্তু কিছু মানুষ বিভ্রান্ত ছড়ানোর চেষ্টা করে; আমরা নাকি কুরআন- সুন্নাহর আলোকে থাকতে চাই না। কিন্তু আমরা সব সময় কুরআন-সুন্নাহর পক্ষে ছিলাম ও আছি।
তবে রাজনীতির মাঠে এখনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশ এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে কিছু লোক পেছন থেকে কাজ করছে। এই নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের ঐক্য নষ্ট হলে দেশের ক্ষতি হবে। তাই, সবাইকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
তবে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের দিনের সবকটি কর্মসূচিই মানুষের মনকে ছুঁয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বিমান থেকে নেমে জুতা খুলে মাটিকে স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে দল-মত, ডান-বাম সকলের মন জয় করেছেন তিনি। এরপর রাজধানীর ৩০০ ফুট এলাকায় আয়োজিত বিশাল গণসংবর্ধনায় তারেক রহমান বিশ্বখ্যাত নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ঐতিহাসিক উক্তি ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’-এর প্রসঙ্গ টেনে ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’ বাক্য জাতির সামনে তুলে ধরেন। তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করেছে, তেমনি জনমনে সৃষ্টি করেছে কৌতূহল । অনেকে বলছেন, আসলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দৃষ্টিভঙ্গি। তার এ বক্তব্যের পর বিদেশি সংবাদপত্রেও তাকে আগামীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তারেক রহমানের পরিকল্পনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার রূপরেখা আছে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি এমন একটি নীতিনির্ভর ও জ্ঞানভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছে, যা আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারলে তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। তাই বিএনপি প্রস্তুত করেছে, আটটি বিশেষ খাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা। এগুলো হলো- ফ্যামিলি কার্ড, কৃষক কার্ড, স্বাস্থ্যকার্ড, কর্মসংস্থান তৈরি, বেকার যুবকদের জন্য ভাতা, শিক্ষা, ক্রীড়া ও পরিবেশ এবং ধর্মীয় নেতাদের উন্নয়ন সেবা যার প্রতিটিই মানুষের  দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, তারেক রহমানের পরিকল্পনা জাতির মধ্যে আশার খোড়াক জুগিয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা বেড়েছে। তিনি দেশে আসার পর প্রতিটি কাজই দারুণভাবে করতে পেরেছেন। তবে ভোটের মাঠে জোটের ফলে নয়া মেরুকরণে বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ বেড়ে গেল। বিএনপিকে সতর্কতার সঙ্গে ভোটের মাঠে সক্রিয় থাকতে হবে।
বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে জোট নতুন নয়। গত দুই দশকে এটি প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্য অপরিহার্য উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৮০’র দশকের গোড়ায় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকেই জোট রাজনীতির সূচনা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনটি বড় জোটের সমন্বিত ভূমিকা পরবর্তীতে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে জোটকে প্রধান করে কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রথম নির্বাচনেও জোট রাজনীতির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে না নিলে বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হতো না। একই চিত্র দেখা যায় ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সহায়তা ছাড়া সরকার গঠন করতে পারেনি। ২০০১ সালেও জোটের দাপটে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও জোট ছিল অন্যতম নিয়ামক। পরবর্তী বিতর্কিত সকল নির্বাচনেই জোটের প্রভাব ছিল। এবারের জোটের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। একদিকে ইসলামপন্থি জোট অন্যদিকে মধ্যপন্থি জোট। তবে বিএনপি জোটে কিছুটা হলেও বামপন্থিদের অবস্থান রয়েছে এবং ইসলামপন্থি একাংশেরও সমর্থন রয়েছে।