ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আবার সরব হয়ে উঠেছে গতবারের আলোচিত ‘কিংস পার্টি’খ্যাত রাজনৈতিক দলগুলো। সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে (বিএনএম)। ২০২৪ সালের ‘ডামি মার্কা’ নির্বাচনে বিরোধী দলের ভূমিকায় সক্রিয় থাকা দলটির কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান নেতা এবার বিএনপিতে ফেরার চেষ্টা করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করেছে।
বিএনএম চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর এবং সাবেক মহাসচিব ড. মোহাম্মদ শাহজাহানসহ কয়েক নেতা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অন্যদিকে ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামে গঠিত দলটি নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ভাবছে। সূত্র বলছে, নতুন নামে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে দলটি।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দল। সে সময় সরকারঘনিষ্ঠ ও স্বল্প পরিচিত কয়েকটি দল হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং স্বল্প সময়ে নিবন্ধনও পায়। বিএনপি থেকে দলছুট অনেক নেতা ওই সব দলে যোগ দিয়েছিলেন। নির্বাচনে বৈধতা পেতে সরকার এসব দলকে প্রভাবিত করে—বিরোধী মহলে এমন অভিযোগ আছে। নির্বাচনের পর দলগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে নতুন নির্বাচনের আগে কেউ বিএনপিমুখী, কেউ নতুন জোট গঠনে ব্যস্ত আবার কেউ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থাকার দিকে ঝুঁকছেন।
বিএনএমে স্থবিরতা, নেতারা বিএনপিমুখী
২০২৩ সালের ১০ আগস্ট নিবন্ধন পাওয়া বিএনএম গঠনের পরপরই ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। দলটির মহাসচিব পদে নিজেকে নিয়োগ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মোহাম্মদ শাহজাহান। বিএনপির সাবেক এমপি শাহ মো. আবু জাফর ভাইস চেয়ারম্যান এবং পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দলটি ২০২৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ৫৬ আসনে প্রার্থী দেয়। বর্তমানে দলটির কার্যক্রম কার্যত বন্ধ।
সরকার পতনের পর বিএনএমের বহু নেতা নতুন রাজনৈতিক আশ্রয় বা বিএনপির সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি সাবেক মহাসচিব শাহজাহান বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে নিয়ে চাঁদপুরে একটি অনুষ্ঠান করেন।
অভিযোগ উঠেছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার কাছ থেকে ৬০০ কোটি অনুদান পায় বিএনএম। এ টাকার পুরোটা হাতিয়ে নেন শাহজাহানসহ দুই-তিনজন। আবার জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলন দমনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে শাহজাহানের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। ভূমি দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আরো তিনটি মামলার কথাও জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি হাসিনার অন্যতম সহযোগী ও জুলাই হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পরও বিএনএমের নেতা শাহজাহানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে ড. শাহজাহান বলেন, হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এসব মামলা করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় অর্থ পাওয়া-সংক্রান্ত কথাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমি এখন রাজনীতিতে সক্রিয় নই। শেখ হাসিনার সময়ে নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে চাপে পড়েছিলাম। সেজন্য দল থেকে পদত্যাগ করি।
বিএনপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি এখন অনেক অসুস্থ। রাজনীতি নিয়ে ভাবছি না। এ সময় তিনি এ প্রতিবেদককে নিউজ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, পুরোনো বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।
বিএনএমের প্রতিষ্ঠাকালীন মুখপাত্র ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন বলেন, বিএনএম মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনি প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই আমরা দল ছাড়ি। তার অভিযোগ, শাহজাহান নির্বাচনের সময় বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিলেন এবং এখন সে প্রভাব ব্যবহার করে বিএনপিতে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।
সূত্রমতে, জুলাই বিপ্লবের পর বিএনএমের কয়েক নেতা সরকার ও বিএনপির ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। কেউ কেউ এখন নিয়মিত সরকারের দুয়েকজন উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাওয়া-আসা করছেন। সেসব উপদেষ্টার সঙ্গে তার ব্যাপক সখ্য রয়েছে বলেও বিভিন্ন মহলে প্রচার করছেন। এছাড়া নিজের ফেসবুকে কখনো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণ আবার কখনো রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের ভাইয়ের সঙ্গে তোলা ছবি শেয়ার করছেন।
শাহ আবু জাফর বিএনএমের চেয়ারম্যান, পাশাপাশি জনতা পার্টি বাংলাদেশের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন। বর্তমান মহাসচিব ড. আব্দুর রহমানও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। তিনিসহ মধ্যম সারির অনেক নেতা এখন বিএনপির আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
শাহ আবু জাফর এসব বিষয়ে বলেন, বিএনএমের তেমন কোনো কার্যক্রম না থাকায় বর্তমানে অফিসে যাওয়া হচ্ছে না। জনতা পার্টি তাকে উপদেষ্টা পদে রেখেছে। বিএনপিতে ফেরা বা তাদের সঙ্গে নির্বাচনি জোটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বিএনপির লোক ছিলাম। আমার সেখানে ফেরার ইচ্ছা থাকার পাশাপাশি বিএনপিরও তো আগ্রহ থাকতে হবে।
স্থবির তৃণমূল বিএনপির কার্যক্রম
গত নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা তৃণমূল বিএনপি এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার মৃত্যুর পর দলটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ১৩৫ আসনে প্রার্থী দেয়। তবে কোনো আসনেই জয় পায়নি।
দলটির বর্তমান চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে। দলটির নাম পরিবর্তনের বিষয়টি মৌখিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে।
দলটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। এ সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না। নাম পরিবর্তনের কথা জানিয়েছি, অনুমোদন না পেলে নতুনভাবে ভাবব।
নতুন জোট বিএসপির
২০২৩ সালের ১০ আগস্ট নিবন্ধন পাওয়া বিএসপি গত নির্বাচনে ৭৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। চট্টগ্রাম-২ আসনে দলীয় চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ মাইজভাণ্ডারী মাত্র তিন হাজার ১৫১ ভোট পান। এছাড়া ওই নির্বাচনে পুরো দলের ভরাডুবি হয়।
নির্বাচনে ব্যর্থতার পর দলটি নতুন করে ‘বৃহত্তর সুন্নি জোট’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিএসপি, বাংলাদেশি ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ—এ তিন দলের সমন্বয়ে জোটটি আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিভাগীয় শহরগুলোয় ১৩ দফা দাবিতে জনসভাও করা হচ্ছে।
যুগ্ম মহাসচিব ইব্রাহিম মিয়া বলেন, সুন্নিপন্থি দলগুলোকে নিয়ে আমরা জোট করেছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিএনপির আপত্তি
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে দুর্বল করতে বিএনএম নেতারা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিলেন। ‘ডামি মার্কা’ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনকে বৈধতা দেয়। ওই দলের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক হতে পারে না। অন্য দলগুলোর ব্যাপারেও তিনি একই ধরনের মত দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমার দেশকে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অবৈধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেটাকে বৈধতা দেওয়া দলের যেমন বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই, তেমনি ওই দলের কোনো নেতারও বিএনপিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই।