Image description
ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১৪টি আসনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে ১১টি করে ২২টি আসন। ১০টি করে আসন ময়মনসিংহ, রংপুর ও খুলনা বিভাগে। বরিশালে ৩টি এবং সিলেটে ১টি আসনে অসন্তোষ।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনো চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেনি বিএনপি। তবে মনোনয়নের জন্য ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৭০ আসনে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের অন্য নেতাদের সমর্থকেরা ক্ষোভ-বিক্ষোভ করছেন, সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছেও অনেকে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির মতো একটি বড় দলে মনোনয়ন নিয়ে এমন পরিস্থিতিকে অবশ্য ‘অস্বাভাবিক’ মনে করছেন না দলটির নীতিনির্ধারকেরা। পরিস্থিতি সামলাতে তাঁরা তৎপর আছেন, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করছেন। এরই অংশ হিসেবে অন্তত ৩০ আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল বুধবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে কাজ চলছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা নিরসনে তাঁরা কাজ করছেন। আশা করছি, সময়মতো এর ভালো একটা সুরাহা হবে।’

গত ৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিএনপি। এর আগে দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে মনোনয়ন নিয়ে বিভেদ বা অসন্তোষ যেন না হয়, সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিভিন্ন বক্তৃতায় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের পর মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ ও অসন্তোষকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। নিজ নিজ এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রাণঘাতী সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা।

মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষের চিত্র

২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন বা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থকেরা। সারা দেশ থেকে আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের দেওয়া হিসাব মতে, অন্তত ৭০টি আসনে এসব ঘটনা ঘটেছে।

বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে সব বিভাগেই অসন্তোষ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের সর্বোচ্চ ১৪টি আসনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে ১১টি করে ২২টি আসনে এবং ময়মনসিংহ, রংপুর ও খুলনা বিভাগে ১০টি করে আসন, বরিশালের ৩টি এবং সিলেট বিভাগের ১টি আসনে অসন্তোষের খবর পাওয়া গেছে।

মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিদের অভিযোগ, ঘোষিত অনেক আসনে নব্য, হাইব্রিড, বিগত দিনের সুবিধাভোগী, আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় ছাড়াও প্রবাসের অনেককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য ওই তালিকায় ত্যাগী, যোগ্য আর জনপ্রিয় নেতাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এই তালিকা চূড়ান্ত নয় এবং তা পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে; দলের পক্ষ থেকে এমনটা বলা হলেও মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ কমছে না।

ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এম ইকবাল হোসেইনকে পরিবর্তনের দাবিতে ওই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক তায়েবুর রহমানের কর্মী-সমর্থকেরা বিক্ষোভ করে আসছেন শুরু থেকে। দাবি আদায়ে তাঁরা সমাবেশ কর্মসূচিও পালন করেছেন। মনোনয়নকে ঘিরে সৃষ্ট কোন্দলের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে সাবেক এমপি মুশফিকুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে বিপরীত পক্ষ অভিযোগ করেছে, নব্বই বছরের ঊর্ধ্বের একজন বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হয়নি। বিগত সরকারের লোকজনের সঙ্গে তাঁর আঁতাতের অভিযোগও উঠছে। তাঁর প্রার্থিতা বাতিলে প্রায় প্রতিদিন বিক্ষোভ হচ্ছে এই আসনে।

একই ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়া-৪ আসনে। আশি বছরের বেশি সাবেক এমপি সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমিকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন এই আসনে মনোনয়ন চাওয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বয়ক শেখ সাদী। তরুণ প্রজন্ম আর নারী ভোটারদের কাছে টানতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মসূচি পালন করে আসছেন তিনি। এখানে মনোনয়ন পরিবর্তন না হলে অঘটন ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা।

রাজধানীর মনোনয়ন নিয়েও বিতর্ক আছে। ঢাকা-৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে নবীউল্লাহ নবীকে। তাঁকে নিয়ে একদিকে যেমন বিতর্ক রয়েছে, তেমনি বয়সের হিসাবও ভাবাচ্ছে দলকে। ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন সানজিদা ইসলাম তুলি। প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার দাবি তুলছেন এস এ সিদ্দিক সাজুর সমর্থকেরা।

সাজুর মনোনয়ন দাবিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ১২৬ জন পদধারী নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে আবেদন জমা দিয়েছেন। এ দাবিতে নিয়মিত কর্মসূচিও পালন করছে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশ। দলের নীতি-আদর্শ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যের অভিযোগে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক সাজুকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম-১২ আসনে ৫ আগস্টের পর এস আলম গ্রুপের গাড়িকাণ্ডে দল থেকে বহিষ্কৃত ও বিতর্কিত নেতা এনামুল হককে মনোনয়ন দিয়েছে দল। যদিও বহিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে বিএনপির তৃণমূল কর্মীরা অভিযোগ করেন, এনামুল হক আওয়ামী লীগ আমলে চাল ব্যবসায়ী হিসেবে আঁতাত করে ব্যবসা ও রাজনীতি করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ফ্যাসিবাদী শাসনামলে যখন সাধারণ কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছেন, তখন এনাম ছিলেন সুবিধাভোগী।

গাইবান্ধা-৪ আসনের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এক-এগারোর সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ শামীম কায়সার লিঙ্কনকে। এটা মানতে পারছেন না তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একাংশ। এই আসনে দলের আরেক জনপ্রিয় নেতা জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদকে মনোনয়ন না দিলে এই আসন হাতছাড়া হবে বলে আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা।

নৈতিক চরিত্রের অধঃপতনের একাধিক ভিডিও চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ায় নেত্রকোনা সংসদীয় আসন নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা উপজেলা) বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রাথমিক সম্ভাব্য ঘোষিত প্রার্থী আবু তাহের তালুকদারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে নেতা-কর্মীদের।

নরসিংদী-৪ আসনে বিএনপির সম্ভ্যাব্য প্রার্থী হিসেবে সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। সাবেক এই এমপি এক-এগারোর সময়ে সংস্কারপন্থী ছিলেন। জিয়া পরিবারকে নিয়ে কটূক্তি করা ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে বিগত বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সখ্য নিয়েও নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে বিএনপির প্রয়াত নেতা ফজলুর রহমান পটলের ছোট মেয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফারজানা শারমিন পুতুলকে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছে দল। কিন্তু তাঁর আপন বড় ভাই ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইয়াসির আরশাদ রাজন বোনের প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন।

পরিস্থিতি সামলাতে তৎপর দল

গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে বিতর্কিত ও সমালোচিত প্রার্থীদের পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্র বলছে, সিলেট-৬, নেত্রকোনা-৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, জামালপুর-২, কুষ্টিয়া-৪, সিরাজগঞ্জ-৩, চট্টগ্রাম-১২ ও ১৩ ছাড়াও অন্তত ৩০ আসনে প্রার্থী বদলের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব আসনে মনোনয়ন দেওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ক্ষোভ-অসন্তোষ ও দাবিকে যুক্তিযুক্ত মনে করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন, এমন একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মনোনয়নসংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে বিএনপির একটি দল কাজ করছে। তারা অভিযোগের বিপরীতে সত্যটা জানার চেষ্টা করছে। তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রার্থীর তালিকা সংশোধন করা হবে।

সূত্র বলছে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিরোধপূর্ণ প্রতিটি আসনের সব পক্ষকে ঢাকায় ডেকে কথা বলছেন। ইতিমধ্যে গুলশান কার্যালয়ে একাধিক জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এর বাইরেও সুবিধাজনক স্থানে মনোনয়নবঞ্চিতদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করছেন তাঁরা। মনোনয়ন নিয়ে বড় কোনো ক্ষোভ-অসন্তোষকে সঙ্গী করে ভোটের লড়াইয়ে যেতে চান না তারেক রহমান। এ জন্য তিনি নিজেও মনোনয়ন না পাওয়া ক্ষুব্ধ অনেক নেতার সঙ্গে আলাপ করছেন।