
আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জোটকেন্দ্রিক ভোটের আলোচনা তুঙ্গে। বিশেষ করে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কোন দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা বা জোটে যাবে, তা নিয়ে বাড়ছে আগ্রহ।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াত— দুই দলের সঙ্গেই এনসিপির অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ চলছে। তবে জোট বা আসন সমঝোতায় যাওয়ার আগে দলটি লাভ–ক্ষতির হিসাব কষছে।
এনসিপির একাংশ মনে করছে, জামায়াতের সঙ্গে সরাসরি জোট না করে সীমিত নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে। অন্যপক্ষের আগ্রহ বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচনী সহযোগিতা গড়ায়। আবার দলের আরেকটি অংশ চায়, এনসিপি এককভাবে বা নিজেদের নেতৃত্বে নতুন একটি জোট গঠন করুক।
তবে এনসিপির একটি সূত্র বলছে, যদি শেষ পর্যন্ত পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য তৈরি হয় তাহলে কোনও জোট ছাড়াই এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এনসিপি।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, 'আমরা কারো সাথে জোটে যাচ্ছি নাকি বা এককভাবে নির্বাচন করবো সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো হয়নি। আমরা পরিস্থিতি বিবেচনা করছি'।
এনসিপি গঠনের পর থেকেই এনসিপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর এক ধরনের সখ্যতা দেখা গিয়েছিল। এর বিপরীতে বিএনপির সাথে এক ধরনের বৈরী সম্পর্কও দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি জুলাই সনদ স্বাক্ষর ঘিরে জামায়াতের সাথে এক ধরনের টানাপোড়েনও তৈরি হয়েছে এনসিপির। যা স্পষ্ট হয়ে গত রোববার এনসিপির শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যদি তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে চায় তাহলে দলটির উচিত এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, 'এখন এনসিপি যদি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে চায় তাদের কৌশল হওয়া উচিত এককভাবে নির্বাচন করা। তবে চাইলে তারা দুয়েক জায়গায় আসন সমঝোতাও করতে পারে'।
বিএনপির সাথে জোটে যাবে এনসিপি?
রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ কিংবা রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে গত কয়েক মাস ধরেই বিএনপির সাথে এনসিপির এক ধরনের টানাপোড়েন দেখা গেছে রাজনীতির মাঠে।
এ নিয়ে প্রকাশ্যে সভা সমাবেশে এনসিপি নেতাদেরও অনেককে বিএনপির সমালোচনাও করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদেরও অনেককে এনসিপির সমালোচনা করতে দেখা গেছে নানা ইস্যুতে। বিশেষ করে সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি ও এনসিপির মতপার্থক্য দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন আরো বাড়তে থাকে।
বিএনপি নেতাদের অনেককে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টাদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যও করতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। আবার দেশের কোথাও কোথাও এনসিপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলা কিংবা বাধা দেওয়ারও অভিযোগও উঠেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ, সংস্কারের বেশ কিছু ইস্যুতে বেশ মত পার্থক্য দেখা গেছে বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে।
একদিকে এই দুটি দলের মধ্যে যখন সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে তখন পর্দার আড়ালে বিএনপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতা কিংবা জোট গঠনের আলোচনার কথাও বলেছে দলটির নেতাদের কেউ কেউ।
তবে এনসিপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির সাথে জোট গঠনের বিষয়ে এনসিপির মধ্যে দুই ধরনের অবস্থান আছে নেতাদের মধ্যে।
দলের যে পক্ষটি বিএনপির সাথে জোট গঠনের পক্ষে তাদের মত হচ্ছে, নির্বাচনে যদি বেশি সংখ্যক আসন ছাড় দেওয়া হয় তাহলে বিএনপির জোটে যেতে আগ্রহী তারা। সেক্ষেত্রে এনসিপির প্রত্যাশা অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি আসনে বিএনপি ছাড় দেয়, তাহলে তারা বিএনপি জোটে কিংবা বিএনপির সাথে আসন সমঝোতায় যেতে রাজি।
আর অন্য পক্ষটির বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচনে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কোও কোনও আসনে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করতে পারে। যেটি এনসিপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, 'আপাতত বিএনপির সাথে জোট বা আসন সমঝোতা কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেই নি'।
তবে শেষ পর্যন্ত এনসিপির সাথে জোট বা সমঝোতার সুযোগ আছে সেটি বলছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে দুই দলের নেতাদের মধ্যে যোগাযোগও হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, 'রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নাই। নির্বাচনের আগে মাঠের পরিস্থিতি দেখেই তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে'।
জামায়াত নিয়ে যে আলোচনা
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে জামায়াতসহ ছয়টি দল পাঁচটি অভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামে। তখন সেই আন্দোলনে এনসিপিরও থাকার কথা ছিল। তবে দাবি নিয়ে মতবিরোধ তৈরির পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মত পার্থক্য তৈরি হয়।
এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ই অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জামায়াতের যোগ দেওয়া কিংবা বাস্তবায়ন কোন প্রক্রিয়ায় হবে তা নিয়ে জামায়াত ও এনসিপির টানাপোড়েনও তৈরি হয়।
সর্বশেষ পিআর বা আনুপাতিক নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনকে সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা বলে মন্তব্য করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে পোস্ট দেন। তার পাল্টা জবাবও দিতে দেখা যায় জামায়াত নেতাদের।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে জামায়াতের সাথে নির্বাচনী সমঝোতা কিংবা জোট গঠনের সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়েও নানা আলোচনা চলছে।
এনসিপির একটি পক্ষের অবস্থান, নির্বাচনের মাঠে জামায়াতের সাথে জোট বা আসন সমঝোতা হলে সেক্ষেত্রে বেশি আসন ছাড় দিতে পারে জামায়াত। অন্যদিকে জামায়াতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটে অংশ নেবে না বলেও মনে করে একটি পক্ষ। যে কারণে দলটির কোনও কোনও নেতা বিএনপির চাইতে জামায়াতের সাথে জোট গঠনের বিষয়ে আগ্রহী।
আর অন্য পক্ষটির মতামত হচ্ছে- শেষ পর্যন্ত যদি জামায়াতের সাথে সমঝোতা বা জোট করে নির্বাচনে অংশ নেয় এনসিপি, তাহলে বিরোধী দলে অবস্থান হতে পারে দলটির। অন্যদিকে, জামায়াতের রাজনীতির ট্যাগও দলটিকে পিছিয়ে দিতে পারে। সেই দিক বিবেচনা করে ওই পক্ষটি জামায়াতের সাথে জোট বা আসন সমঝোতার বিষয়ে কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে রয়েছে।
বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টাদের একজন জামায়াতের সাথে জোট বা সমঝোতায় না যাওয়ার পক্ষেও তার অবস্থানের কথা এনসিপিকে জানিয়েছে বলে এনসিপির একজন নেতা বলেছেন।
তবে এনসিপি নেতা সারজিস আলম বলেছেন, 'জামায়াতসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা চলছে। তবে, এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তই হয়নি কার সাথে এলায়েন্স হবে। কার সাথে যাবো সেই সিদ্ধান্ত হলেই তারপর না হয় আসন নিয়ে দরকষাকষি হলেও হতে পারে'।
এদিকে সাম্প্রতিক টানাপোড়েন থাকলেও সংস্কার ইস্যুতে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে বেশ কিছু ইস্যুতে মতৈক্য রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেটি নির্বাচনী সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, 'আমার ধারণা আরেকটু সময় গেলে স্পষ্ট হবে কে কোন জোটে বা কার সাথে সমঝোতায় যাবে। এনসিপির সাথে সমঝোতা বা জোট গঠনের সুযোগ তো আছেই। আমরা আলোচনা করছি আমাদের মধ্যে মতবিনিময়ও হচ্ছে'।