Image description
ক’জন উপদেষ্টা ও ফ্যাসিবাদের দোসর আমলাদের নিয়ে বিতর্ক, বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পদায়নে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ : প্রধান উপদেষ্টার হাতে আলোচিত উপদেষ্টা ও দলবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা :: বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতÑ তিন দলই চায় বিতর্কিত উপদেষ্টা ও দলবাজ আমলাদের নির্বাচনের আগেই বাদ দেয়া হোক

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য অনুযায়ী, নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে। দেশ-বিদেশ সব খানে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন ইতিহাসের সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সরকার ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন-ইসি। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচনী প্রতিযোগিতার। তবে বর্তমান দলবাজ এবং দিল্লির অনুগত আমলা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করছে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জুলাই আন্দোলনে গড়ে উঠা দল-এনসিপি। এ দুটি দল মনে করে, উপদেষ্টা পরিষদে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছে, যারা বেশ কিছু পদে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছেন। তাই যাদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অথবা যারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন অথবা যারা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা সরকারে থাকলে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং ব্যাহত হবে। একইভাবে প্রশাসনে এখনো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের চিহ্নিত দোসররা বহাল তবিয়তে রয়েছেন তাদের রেখেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনের আগে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের এবং প্রশাসনের চিহ্নিত দোসরদের সরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি-এনসিপি। দল দুটি উপদেষ্টা পরিষদ ও প্রশাসনে থাকা দলীয় ব্যক্তিদের তালিকাও দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।

জানতে চাইলে গতকাল আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার পরিবর্তন হবে কি-না এ ধরনের কোনো কিছু আলোচনা হয়নি। নির্বাচনকালীন সরকার ছোট হবে না কেমন হবে, এ ধরনের কোনো দাবিও কোনো মহল থেকে উত্থাপিত হয়নি। আমাদের বিরুদ্ধে সব দলই অভিযোগ করে, এক দল বলে ওই দলের লোক আছে, আরেক দল বলে ওই দলের লোক আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উনারা (বিএনপি) চেয়েছে ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তী) সরকার, যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ভূমিকা পালন করে। নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, এখন জনপ্রশাসন বা অন্য কোনো জায়গায় বড় বড় বদলির ব্যাপারটি তিনি নিজে দেখবেন। বিএনপি বলেছে, ইন্টেরিম সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ভূমিকা পালন করতে হবে।

গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, আমরা বলেছি, কিছু কিছু লোক (উপদেষ্টা) আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বিভ্রান্ত করে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু আপনার কিছু লোক আপনার পাশে আপনাকে বিভ্রান্ত করে এবং ওরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করে আমরা মনে করি। তাদেরকে, তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার। যারা কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে বলেছি, সব উপদেষ্টাদের ব্যাপারে নয়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মনে করেন, বর্তমান সরকারে যদি দলীয় কেউ থাকে, তাদের সরিয়ে দিতে হবে, তা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সময় যদি প্রশাসনে কোনোভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত কেউ থাকে তাদের রাখা যাবে না। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটাই হলো নির্দলীয়তা। নির্দলীয় হলে সেখানে রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টা বা দলীয় পরিচয়ের লোকদের থাকার কোনো কারণ নেই। রিজভী বলেন, গত ১৫ বছরের নানা ধরনের অপকর্মে যারা জড়িত এবং যারা ফ্যাসিস্টদের রক্ষা করতে গিয়ে বেআইনি কাজ করেছেন, তাদের প্রশাসনে রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা গোপনে থাকেনি, অনেকে প্রকাশ্যেই সহযোগিতা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপ নেবে তখন তা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হওয়া উচিত; তা হলে বিগত ১৬ বছর যারা ভোটে বিশ্বাস হারিয়েছেন তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা পাওয়া যাচ্ছে না। জনপ্রশাসনে যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বদলি হচ্ছে কি নাÑ তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অনেক বড় দলের রেফারেন্সে কর্মকর্তাদের (এসপি-ডিসি) পদায়ন হচ্ছে। সরকার যেন এসব বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে এর দায় সরকারের ওপর বর্তাবে। তিনি বলেন, ছাত্র উপদেষ্টারা কোনো দলের প্রতিনিধি নন, তারা গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন। সরকার গঠনের সময় অনেক দলের রেফারেন্সে উপদেষ্টাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বিষয়ও সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। প্রশাসন ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে অভিযোগ করে নাহিদ বলেন, জনপ্রশাসনে দলীয়করণ হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। এমনকি উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও এ ব্যাপারে সহায়তা করা হচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলীয়করণের অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। সেই সরকারে ড. ইউনূস ছাড়াও ২২ জন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পদমর্যাদায় তিনজন বিশেষ দূত ও প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার ছয়জন বিশেষ সহকারী রয়েছে। সরকার গঠনের পর থেকেই সচিবালয়কেন্দ্রিক প্রশাসন, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন এবং পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনে রদবদল করা হয়। তবে এখনো ফ্যাসিস্টদের চিহ্নিত অনেক দোসরই প্রশাসনে বহাল তবিয়তে রয়েছে। বিশেষ করে প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এককভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি এসব মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তাদের দলীয় ও মতাদর্শী নিয়োগ দিয়ে পুরো প্রশাসন যন্ত্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এছাড়া আগামী নির্বাচনে যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে সেসব প্রতিষ্ঠানেও লোকবল নিয়োগ দিয়ে ফেলেছে জামায়াত।

এই অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র সাড়ে তিন মাসের মতো সময় বাকি। তাই নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও প্রশাসন পরিচালনায় কয়েকটি দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এতদিন বড় পরিসরে সরকার পরিচালনা করলেও জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করার দাবি জানিয়েছে দলটি। এছাড়া সরকারে থাকা যেসব উপদেষ্টা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে নির্বাচনের আগে তাদেরকে সরকার থেকে চলে যেতে হবে বলেও দাবি তুলেছে দলটি। একই সাথে প্রশাসনে থাকা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের চিহ্নিত দোসর যারা আছে তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার কথা বলছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের বৈঠকে এসব দাবি তোলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় তিনি প্রশাসনে থাকা দোসরদের একটি তালিকাও প্রধান উপদেষ্টার হাতে দেয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, নির্বাচন অর্থবহ, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এই মুহূর্ত থেকে প্রয়োজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নিতে হবে। প্রশাসনকে পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষ তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে সচিবালয়ে চিহ্নিত ফ্যাসিস্টদের দোসররা বহাল রয়েছে, তাদেরকে সরিয়ে সেখানে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা দেয়ার জন্য আমরা বলেছি, জেলা প্রশাসনেও একইভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তারা এখনো সেই ফ্যাস্টিস সরকারের স্বার্থ পূরণ করছে। সেজন্য তাদেরকে অপসারণের কথা আমরা বলেছি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ব্যবস্থা নেয়া, বিচার বিভাগেও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের সরিয়ে নিরপেক্ষ বিচারকদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে বলেছি। নির্বাচনকালীন সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথাও আমরা বলেছি। সরকারের মধ্যে যদি কোনো দলীয় লোক থেকে থাকেন তাকে অপসারণ করার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।

অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, নির্বাচনের আগে তাদের সরকার থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যেহেতু নির্বাচনের আগে আর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে না, সেহেতু এই সরকারকে শিগগিরই কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

সুন্দর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা ভালো পরিবর্তন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, একটা সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা চাই একটা ভালো পরিবর্তন। যারা সরকারে আছেন, প্রফেসর ইউনূসের প্রতি আমাদের সম্মান আছে, উনাদের তো সম্মানের সঙ্গে যেতে হবে। আমরা সেটি চাই। কিন্তু কিছু লোকের কার্যকলাপের মাধ্যমে সেটি বিঘ্নিত হতে পারে। এ জন্য বলি, পুরোপুরি কেয়ারটেকার সরকারের মুডে চলে যান। যাদের নিয়ে বিতর্ক আছে, এই লোকগুলোকে চলে যেতে হবে। সেখানে থাকলেই সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ, পুরোপুরি নিরপেক্ষ অবস্থানে যাওয়া উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারের ভেতরে-বাইরে যাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার সুযোগ আছে, তাদের রেখে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যাবে না। এই প্রশ্ন আসছে বিভিন্ন কারণে। বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এ সরকারের বেশ কিছু পদে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাই যাদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অথবা যারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন অথবা যারা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সরকারে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ভূমিকা, তা ব্যাহত হতে পারে।