
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর নৃশংস হামলার পর রাজনৈতিক অঙ্গন আবার সরগরম হয়ে উঠেছে। শুক্রবার রাতে রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণ-অধিকার পরিষদের সংঘর্ষ এবং পরে সেনা-পুলিশের লাঠিপেটায় নুরসহ বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন হিসাব-নিকাশ চলছে। ঘটনাটি কেবল তাৎক্ষণিক সহিংসতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আগামী নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ অঙ্কের সাথেও জড়িয়ে গেছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
দুইটি আলোচ্য বিষয় সামনে
রাজনীতিতে এখন প্রধানত দু’টি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- ১. জাতীয় পার্টিকে ঘিরে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কি শুরু হয়েছে? ২. আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসানোর কোনো গোপন প্রচেষ্টা কি চালানো হচ্ছে?
গণঅধিকার পরিষদ (গঅপ) বরাবরই জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে। তবে এতদিন সেটি খুব আলোচনায় না এলেও নুরের ওপর হামলার পর এই দাবি নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে।
নির্বাচনপূর্ব প্রেক্ষাপট ও জাপার ভূমিকা
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষমতার সমীকরণে বড় পরিবর্তন এসেছে। সেই শূন্যতা পূরণে কে বিরোধী দলের আসনে বসবে, কে নির্বাচন-উত্তর ভারসাম্য রক্ষা করবে- এই প্রশ্ন এখন মুখ্য।
গত মে মাসে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ‘শেখ পরিবার’ বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্বে দলটিকে পুনর্গঠনের আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এর পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে জাতীয় পার্টি। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক কাজে লাগিয়ে জাপাকে সামনে আনার চেষ্টা চলছে, যাতে ভবিষ্যতে আওয়ামী পুনর্বাসনও সহজ হয়।
জাপার বিতর্কিত ইতিহাস
জাতীয় পার্টি তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা জুগিয়েছে। নির্বাচনের আগে মন্ত্রিত্বও আদায় করেছে। ভারতের ভূমিকা নিয়েও নানা আলোচনা আছে। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর জাপাকে কাঠগড়ায় তোলা হলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটি আবার সক্রিয় হয়। এখন সেটিকে বিরোধী দল বানানোর গোপন অঙ্ক চলছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হামলার পর নতুন দাবি ও উত্তেজনা
নুরের ওপর হামলার পর গণঅধিকার পরিষদ জাপাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান অভিযোগ করেছেন, “আওয়ামী লীগের এজেন্টরা মিলে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বানানোর চেষ্টা করছে।”
গঅপ-এর এক নেতা ফেসবুকে লিখেছেন, “ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে জাপার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা চলছে, আর নুর ভাই প্রথম রক্ত দিলেন।”
রাজধানীতে গতকাল জাপার কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথেও।
আইনগত দিক ও সরকারের অবস্থান
অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেছেন, “জাপা ১৯৮২-৯০ সালে মানুষের রক্তের সাথে বেইমানি করেছে। জুলাই বিপ্লবেও আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে। তাই দলটিকে নিষিদ্ধের দাবির আইনি দিক খতিয়ে দেখা হবে।”
অন্য দিকে আজ বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি জোটের সাথে বৈঠক ডেকেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৈঠকে আসন্ন নির্বাচন, বিরোধী দলের ভূমিকা এবং জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিশ্লেষণ এক. নির্বাচনের অঙ্ক : আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিরোধী দলের জায়গা পূরণে জাপাকে ব্যবহার করা হতে পারে। দুই. রাজনৈতিক ঝুঁকি : জাপাকে বিরোধী দল বানানো হলে তা গণ-আন্দোলনের চেতনাকে আঘাত করতে পারে। তিন. ভারতের ভূমিকা : বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লির কূটনৈতিক প্রভাব এই সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ।
নুরের ওপর হামলার পর দলটি সরাসরি জাপা নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। আগামী দিনের প্রশ্ন- জাতীয় পার্টি কি টিকে থাকবে নাকি আওয়ামী লীগের মতো নিষিদ্ধ হবে? আসন্ন নির্বাচনের আগে এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে দেশের রাজনৈতিক পথরেখা।
নির্বাচনের অঙ্ক
বিরোধী দলের জায়গা পূরণে জাপাকে ব্যবহার নিয়ে বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের পতন ও নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিরোধী দলের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি ‘সেফ’ বিরোধী দল দরকার। ক্ষমতাসীনরা এবং বিশেষত ভারত মনে করতে পারে, জাতীয় পার্টি (জাপা) এই জায়গায় ব্যবহারযোগ্য। কারণ ঐতিহাসিকভাবে তারা সব সরকারের ছায়াসঙ্গী ছিল।
বিএনপি এটিকে তাদের জন্য হুমকি মনে করবে। কারণ তারা মনে করে, বিরোধী শূন্য রাজনীতি তাদের জন্য প্রধান দল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জাপাকে কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী করলে বিএনপির রাজনৈতিক ক্ষেত্র সীমিত হবে। বিএনপি নুরকে সাপোর্টিভ অবস্থানে রাখবে, যাতে বিরোধী শিবির বিভক্ত না হয়। তবে ভেতরে ভেতরে তারা চাইবে নুর-গণঅধিকার যেন অনেক শক্তিশালী না হয়।
জামায়াত সরাসরি মাঠে আছে। বৃহত্তর ঐক্য গড়তে পারলে তারা বিএনপির বিকল্প পছন্দ হিসেবে সামনে আসতে পারে। তাই তারা জাপাকে প্রতিস্থাপনমূলক বিরোধী দল বানানোর যেকোনো উদ্যোগকে প্রতারণা হিসেবে দেখবে।
এনসিপির হিসাব হতে পারে তারা নতুন হলেও ‘ক্লিন ইমেজ’ দেখাতে চাইছে। এনসিপি চাইবে বিএনপির পাশাপাশি নিজেদেরও প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে জাপার জায়গা তারা নিতে পারে।
রাজনৈতিক ঝুঁকি হলো দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের দোসর জাপাকে বিরোধী দল বানানোর চেষ্টাকে গণ-আন্দোলনের চেতনাকে আঘাত করা হিসেবে দেখবে।
বাংলাদেশের এখনকার বাস্তবতা হলো- ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলন জনগণের আত্মত্যাগ ও ত্যাগের মাধ্যমে জয়ী হয়েছে। যদি সেই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাপা- যে দলকে মানুষ আওয়ামী লীগের ‘সরকারের দালাল’ হিসেবে দেখে- বিরোধী আসনে বসে, তবে এটি জনগণের আন্দোলনকে ব্যঙ্গ করার মতো হবে।
বিএনপি এ সুযোগে জাপার ‘ভাড়াটে বিরোধী’ চরিত্রকে প্রচারে কাজে লাগাবে। আন্দোলনের উত্তরাধিকারের মালিকানা নিজেদের দিকে টানবে। জামায়াত গণ-আন্দোলনের স্মৃতি ব্যবহার করে নিজেদের প্রধান বিকল্প করার চেষ্টা করবে এবং বলবে- “জুলাই আন্দোলনের পেছনের মূল শক্তি হিসেবে আমাদের মৌলিক অবদান ছিল।” এনসিপি সরাসরি বলবে- গণ-আন্দোলনের আত্মত্যাগকে অপমান করা হচ্ছে। তারা বিপ্লবের মূল শক্তি হওয়ার দাবি তুলবে।
ভারতের ভূমিকা
বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লির কূটনৈতিক প্রভাবের সমীকরণে বাস্তবতা হলো- ভারত ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ‘ম্যানেজেবল’ দল চায়। জাপা সবসময় নরম। তাই দিল্লি চাইতে পারে- বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে জামায়াতকে এড়িয়ে জাপাকে নিয়ন্ত্রিত বিরোধী হিসেবে দাঁড় করাতে।
যদিও বিএনপি এটিকে ভারতীয় হস্তক্ষেপ হিসেবে প্রচারও করতে পারে। বলতে পারে, দিল্লি আবার বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে মারতে চাইছে।
জামায়াত ভারতকে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণকামী ‘প্রধান শত্রু’ বানিয়ে জনগণকে সংগঠিত করতে চাইবে, বিশেষত তরুণ-ধর্মভিত্তিক ভোটারদের কাছে টানতে চাইবে।
এনসিপি চুপচাপ ভারসাম্য বজায় রাখবে। প্রকাশ্যে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে বা না করে জাতীয়তাবাদী মধ্যপন্থীর ইমেজ সৃষ্টি করতে চাইবে।
গণ-অধিকার পরিষদের অবস্থান : জাপা নিষিদ্ধের দাবি
এক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো জাপাবিরোধী অবস্থান নেয়ার মাধ্যমে গণ-অধিকার পরিষদ নিজেদের ‘আন্দোলনের উত্তরসূরি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। জামায়াত নুরকে সমর্থন দিয়ে চেষ্টা করবে দলটিকে তাদের সাথে জোটে আনতে। এনসিপি নুরের বক্তব্যকে কাজে লাগাবে। বলতে পারে- “আমরাও গণ-আন্দোলনের দল, তাই জাপার কোনো বৈধতা নেই।”
জাতীয় পার্টি কি টিকবে নাকি আ’লীগের মতো নিষিদ্ধ হবে? এ প্রশ্নে বাস্তবতা হলো জাপা দীর্ঘদিন ধরে ‘ছদ্মবিরোধী’ হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ তাদের আর গ্রহণ করবে কিনা সেটা বড় প্রশ্ন। যদি গণচাপ বাড়ে, তবে জাপার রাজনীতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
বিএনপি চাইবে জাপা ধীরে ধীরে ভেঙে যাক, যাতে তাদের স্থান পুরোপুরি বিএনপির হাতে আসে। জামায়াতও চাইবে জাপা নিষিদ্ধ হোক- তাহলে বিরোধী রাজনীতিতে জায়গা ফাঁকা হবে। এনসিপি চাইবে জাপার পতনের সাথে সাথে নিজেদের ‘নতুন বিকল্প’ হিসেবে দাঁড় করাতে।