
বরিশালের দুই ভাই ফিরোজ খান ও মিরাজ খান। একসময়ের ছাত্রদল নেতা, রাজপথের লড়াকু সৈনিক। এখন তারা কেবল দুটি নাম, দুটি ছবি; আর এক মায়ের বুকভরা অপেক্ষার গল্প। তাদের দুজনের একজনকে ঢাকা এবং অন্যজনকে চট্টগ্রাম থেকে ২০১২ সালে গুম করা হয়। সেই থেকে তারা নিখোঁজ। সন্তানদের হারিয়ে মা ফিরোজা বেগম এখন দিশাহারা। দীর্ঘ এক যুগ ধরেই তিনি অপেক্ষায় রয়েছেন ছেলেদের ফিরে আসার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার মিরপুরে বেড়াতে আসেন মিরাজ। তখন তার বয়স ছিল ১৬। সেদিন রাত ১০টায় মিরপুরের এক নম্বর গোলচত্বর হয়ে গলির মুখে হাঁটছিলেন তিনি, জহির রায়হান এবং চট্টগ্রামের আরেক যুবক। তারা সবাই সে সময় ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। হঠাৎ সাদা পোশাকে ছয়জন লোক এসে তিনজনের কোমর, দুই হাত বেঁধে ফেলে। মুখে কালো টুপি পরানো হয় তাদের। সরকারি বাহিনীর পরিচয়ে তাদের সিলভার কালারের মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। গাড়ির ভেতরেই ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। রাত ৩টার দিকে মিরাজকে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয় বাকিদের।
মিরাজ বরিশাল সদরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার আয়নাল খানের ছেলে। জহির রায়হান একই এলাকার বাসিন্দা এবং বিএম কলেজ ছাত্রদলের নেতা।
সে রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জহির রায়হান আমার দেশকে বলেন, আমাদের চোখে কালো কাপড় বেঁধে গাড়ির ভেতরে গাদাগাদি করে বসানো হয়েছিল। সেখানে দুজন হিন্দিভাষী ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে। গরমে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এর মধ্যে চলছিল মারধর। লাঠির বাড়ি, লাথি, চড়- সব মিলিয়ে শরীর যেন ভেঙে যাচ্ছিল। আমাদের কান ধরে টেনে ওঠানো হচ্ছিল বারবার। মাথায় আঘাত লেগে ঝরছিল রক্ত। কেউ একজন বারবার বলছিল, পাঁচ লাখ টাকা দে, নইলে বাঁচবি না।
একটু থেমে জহির আবার বলতে শুরু করলেন। তিনি বলেন, রাত ৪টার দিকে হঠাৎ মাইক্রোবাস থামল। ঢাকার চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে আর আরেক বন্ধুকে ফেলে রেখে যায়। কিন্তু মিরাজকে রেখে দিল ওরা। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো পরদিন সে ফিরে আসবে। কিন্তু সেদিন আর আসেনি।
ছোট ভাইকে হারিয়ে বড় ভাই ফিরোজ আতঙ্কে আশ্রয় নেন চট্টগ্রামে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামের ডবলমুরিংয়ের মনসুরাবাদে লুকিয়েও রক্ষা হয়নি। একই বছরের ২৪ আগস্ট মাগরিবের নামাজ শেষে মসজিদের পাশের দোকানে চা খেতে খেতে বন্দুক ঠেকিয়ে কিছু লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা গাড়ির নম্বর লিখে রাখেন। কিন্তু থানার দায় সারেন নিখোঁজের একটি সাধারণ ডায়েরিতেই।
বরিশাল মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমানের সহপাঠী ছিলেন ফিরোজ। ফিরোজ তখন বরিশাল সদরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রদল সভাপতি ছিলেন। ওই ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ফিরোজ আমার ছোটবেলার বন্ধু, রাজনীতির সহযোদ্ধা। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি, পরে ছাত্রদলের রাজনীতিও করেছি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ছোট ভাই মিরাজকে হারানোর পর ফিরোজের ভেতরে এক অজানা ভয় কাজ করছিল। সে বলত, আমারও হয়তো ওদের মতো হাল হবে। তাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
মাহফুজুর যোগ করেন, যেদিন গুম হয়, সেদিন মাগরিবের নামাজ শেষে চা খেতে বসেছিল দোকানে। হঠাৎ কিছু লোক বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে গাড়িতে তোলে। আমাদের চেনা স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি নিজ হাতে গাড়ির নম্বর লিখে রাখেন। আমরা ভেবেছিলাম এবার অন্তত প্রমাণ আছে, ফিরোজকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু না, থানায় গিয়ে দেখি তারা শুধু নিখোঁজ বলে একটি সাধারণ ডায়েরি করে দায় সেরেছে। এরপর আর কোনো তদন্ত হয়নি, কোনো খোঁজও মেলেনি।
ফিরোজকে যেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়, ওই জায়গাটি ডবলমুরিং থানার অধীনে। জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান ওসি বাবুল আজাদ আমার দেশকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থানায় অনেক কিছু নেই। অনেক ফাইল হারিয়ে গেছে। স্বজনের কাছে জিডির কপি থাকলে আমাদের কাছে আসতে পারেন। আমরা মামলা নেব।
দুই ছেলের অপেক্ষায় শয্যাশায়ী মা
মা ফিরোজা বেগম এখন শয্যাশায়ী। একে একে দুই ছেলেকে হারানোর দুঃখে জীবন যেন থমকে গেছে তার। বড় ছেলে ফিরোজের স্ত্রী আমেনা বৃষ্টি সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সন্তান জিসান এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র; কিন্তু বাবার মুখ মনে করতে পারে না।
ফিরোজা বেগম বলেন, আমার বুকের দুই ধন ফিরোজ আর মিরাজকে একে একে কেড়ে নিল ওরা। ছোট ছেলে মিরাজ মাত্র ১৬ বছর বয়স, তাকেও ছাড়ল না। তারপর বড় ছেলে ফিরোজ, আমার আশার আলো, তাকেও চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ মসজিদ থেকে তুলে নিয়ে গেল। কেউ কিছু বলল না, কেউ কিছু করল না।
ফিরোজ খানের স্ত্রী আমেনা বৃষ্টি বলেন, গুমের সময় র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান ছিলেন জিয়াউল আহসান। তখন জিয়াউলের ছোট ভাই লেটো বিপ্লব নামে পরিচিত বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। লেটো বিপ্লব মাকে ব্যক্তিগতভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন ফিরোজকে হত্যা করা হয়নি; তাকে ভারতের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে লেটো বিপ্লব নিজেই পলাতক হয়ে পড়েন।
আমেনা বৃষ্টি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে নানা অনিয়ম ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি ঘোষিত হরতালসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিতেন ফিরোজ খান। আন্দোলন চাঙা রাখার দায়ে তাকে বারবার রাজনৈতিক মামলা দিয়ে হয়রানি করে পুলিশ। এক পর্যায়ে তাকে গুম করার পরিকল্পনা করা হয়। সে পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে প্রথমে অপহরণ করা হয় ফিরোজের ছোট ভাই ও ওয়ার্ড পর্যায়ের ছাত্রদল নেতা মিরাজ খানকে। পরে গুম করা হয় ফিরোজকে।
তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন জিয়াউল
ছেলেদের গুম করা হতে পারে- এমন কথা বহুদিন ধরে শুনছিলেন ফিরোজা বেগম। তার ভাষ্য, বরিশালের বিএনপি নেতা মুজিবুল হককে র্যাবের জিয়াউল খবর দিয়ে বলেছিলেন, ওদের আত্মসমর্পণ করতে বলো, না হলে পরিণতি খারাপ হবে।
এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে দুই ভাইকে গুম করা হয়। তারপর শুরু হয় ফিরোজা বেগমের হাহাকার। তিনি কাঁদতে কাঁদতে ছুটেছেন র্যাব অফিসে, পুলিশ স্টেশনে। অনুরোধ করেছেন তার দুটি ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু কারো মন গলেনি, কেউ তার কথায় সাড়া দেয়নি। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শুধু মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর কয়েকজন সদস্য। তাদের সাহসে মা ও পরিবার বছরের পর বছর ঢাকা, বরিশালে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন ছেলেদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে।
ফিরোজের স্ত্রী আমেনা বৃষ্টি এখনো বিশ্বাস করেন, একদিন ফিরোজ ফিরে আসবেন।
অধিকারের বরিশাল বিভাগের ফোকাল পারসন আজিজ শাহিন আমার দেশকে বলেন, বিএনপির সাবেক এমপি মুজিবুর রহমানের রাজনীতি করত বলে ওই দুই ভাইকে গুম করা হয়। এরই মধ্যে এক যুগ কেটে গেছে। এক মা হারিয়েছেন তার দুই সন্তানকে। এক স্ত্রী স্বামী ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। এক শিশু জানে না তার বাবা কোথায়। আয়না ঘরের গোপন রহস্য ফাঁস হওয়ার পরও ফিরোজ-মিরাজের হদিস মেলেনি। তবুও বুকভরা আশায় মা ফিরোজা বেগম আর স্ত্রী আমেনা বৃষ্টি অপেক্ষায় রয়েছেন একদিন হয়তো ফিরে আসবে তাদের প্রিয়জনরা।