
জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়ার কয়েকটি বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল সংবিধানের ওপরে স্থান পেতে পারে কি না, এমন প্রশ্ন তুলে দলটি বলেছে, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। এ সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, সরাসরি এমন বিধান রাখারও বিপক্ষে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
বিএনপির এ অবস্থান জুলাই সনদ নিয়ে ভবিষ্যতে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জামায়াতে ইসলামী বলছে, প্রয়োজনে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া যেতে পারে।
বিএনপির সূত্র জানায়, গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সনদের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খসড়া পর্যালোচনা করে দলের বক্তব্য ঠিক করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সনদের সমন্বিত খসড়া নিয়ে দলের অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের স্বার্থে যতটা ছাড় দেওয়া দরকার, ততটা ছাড় দেবে বিএনপি।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। গত ২৯ জুলাই দলগুলোকে জুলাই সনদের একটি খসড়া দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেটি নিয়ে দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় ‘সমন্বিত খসড়া’, যা গত শনিবার সন্ধ্যায় দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। এ বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ আরও কিছু দলের আপত্তি ছিল। তারা সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণের দাবি জানায়।
দলগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত সমন্বিত খসড়ায় অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এখন এই অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি তুলছে বিএনপি। মোটাদাগে অঙ্গীকার অংশের তিনটি দফা ও ভূমিকা নিয়ে আপত্তি আছে দলটির।
অন্যদিকে সনদ বা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হতে পারে।
সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করার এখতিয়ার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আছে কি না, গতকাল সে প্রশ্নও তুলেছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে একই সঙ্গে বলেছেন, সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার জন্য ঐকমত্য কমিশন ডাকলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি।
যেসব দফায় আপত্তি
জনগণের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়, এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করা হবে এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
এ বিষয়ে বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কোনো সমঝোতা দলিল কি ‘সুপ্রা কনস্টিটিউশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট’ (সংবিধানেরও ওপরে) হতে পারে? সংবিধানের মধ্যে থেকে আইনিভাবে বৈধ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় কীভাবে সমঝোতা দলিলটা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করা যায়, সে চিন্তা করতে হবে।
সালাহউদ্দিন বলেন, এখন যদি বলা হয়, এ দলিলের সবকিছুই সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পাবে, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য একটি খারাপ নজির সৃষ্টি হবে। পুরো জাতির জন্য একটি খারাপ নজির সৃষ্টি করা ঠিক হবে না।
খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের ওপর এভাবে ভার দেওয়া যায় কি না, এমন প্রশ্ন রেখে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, হাইকোর্ট ডিভিশনের যেকোনো রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল হয়। তা ছাড়া সাংবিধানিক ব্যাখ্যার বিষয় আপিল বিভাগে যায়। কিন্তু এই দলিল কোনো অধ্যাদেশ বা আইন বা আদালতের রায় নয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কিসের ভিত্তিতে ব্যাখ্যার জন্য এটা সুপ্রিম কোর্টে যাবে, কেন যাবে, কারা নেবেন, সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারই–বা কী।
ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সবাই মিলে একটি আইনগত ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া বের করা সম্ভব হবে।
খসড়ার আরেকটি দফায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
এই এখতিয়ার কি সংবিধান দিয়েছে? এমন প্রশ্ন রেখে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কোনো নাগরিক যদি তার জীবন, সম্পদ বা অন্যান্য যেকোনো বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তার আইনি আশ্রয় লাভের অধিকার আছে, প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে। তিনি মনে করেন, এভাবে বিষয়টি খসড়ায় রাখা ঠিক হবে না। অন্য কোনোভাবে এটা উল্লেখ করা যায়।
সনদে বলা হয়েছে, যেসব সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হবে ডিসেম্বরের মধ্যভাগে। তার আগপর্যন্ত এই যে কয়েক মাস সময় আছে, তা আইনকানুন, বিধিবিধান প্রণয়নের জন্য যথেষ্ট। এক–দেড় মাসের মধ্যেই সব অধ্যাদেশ জারি করা যায়। নির্বাহী আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। সনদে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে’—এই শব্দ উল্লেখ না করলে ভালো হয়।
জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়ায় অঙ্গীকার অংশের সূচনায় মুক্তিযুদ্ধের পর এবং নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে কিছু বিষয় কীভাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল, তার উল্লেখ করা হয়। ওই দুটি সময়ের মতো ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সাংবিধানিক কনভেনশন বজায় রেখে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে’ আটটি বিষয়ে অঙ্গীকার করার কথা বলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটকে একইভাবে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, একাত্তরের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। এখন স্বাধীন রাষ্ট্র আছে, সংবিধান আছে। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এখানে কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন কার্যাবলিকে যেভাবে বৈধতা দেওয়ার কথা জুলাই সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পুনরুচ্চারণ করা হয়। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণীত হয়। তখন যাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তাঁরা মিলে এটি প্রণয়ন করেন। সে ঘোষণাপত্রে অস্থায়ী বিধান রাখা হয় এবং সেই ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাহী ক্ষমতা এবং আইন প্রণয়ন ক্ষমতা দেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রথম আইন ‘দ্য ল’জ কন্টিনিউয়েন্স এনফোর্সমেন্ট অর্ডার ১৯৭১’ প্রণীত হয়। যেটা পরে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সে হিসেবে আইনানুগ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি দিয়ে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হলে তাঁরা বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। তবে বিএনপি ইতিবাচক। কারণ, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সবাই মিলে একটি আইনগত ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া বের করা সম্ভব হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
ঐকমত্য কমিশনের বিভিন্ন বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। জুলাই সনদ নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের এ বক্তব্যের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির এ অবস্থান জুলাই সনদ নিয়ে ভবিষ্যতে বিতর্ক সৃষ্টি করবে। সনদের মাধ্যমে আসা প্রস্তাবগুলোকে একধরনের বিতর্কের মধ্যে নিয়ে আসা এবং সেগুলোকে বাস্তবায়ন না করার এটা একটা প্রক্রিয়া হতে পারে।
এনসিপির নেতা জাবেদ রাসিন বলেন, ‘সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হচ্ছে, আমি আমার অঙ্গীকারকেই যদি আবার ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ করি, বিষয়টা কেমন হয়? জুলাই সনদকে চ্যালেঞ্জের একটা জায়গায় রেখে দিলে পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তিও এটাকে চ্যালেঞ্জ করার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে।’
অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের মনে করেন, জুলাই সনদ সংবিধানের ঊর্ধ্বে কি না, এই সনদের ব্যাখ্যা আপিল বিভাগের এখতিয়ারে পড়ে কি না বা এই সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে কি যাবে না—এসব নিয়ে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, জুলাই সনদের যেসব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ আইনি পজিশন দিতে হবে। এর জন্য নিয়ম-বিধি অনুসরণ করতে হবে। যেভাবে করলে আইনসম্মত হয়, সেভাবে গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সংস্কারের প্রতি আমরা আন্তরিক কি না। যদি আন্তরিক হই, তাহলে এটাকে বাধাগ্রস্ত করা বিজ্ঞোচিত কাজ হবে না।’