Image description

একান্ন বছর বয়সী বিবেক অগ্নিহোত্রী বলিউডের অপেক্ষাকৃত তরুণ পরিচালকদের অন্যতম, যদিও একটি বিশেষ ধারার চলচ্চিত্র তৈরির জন্যই তার পরিচিতি। ২০২১ ও ২০২৩ সালে তার নির্মিত পরপর দু'টি ছবি – 'তাসখেন্দ ফাইলস' ও 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে, তা ছাড়া দেশের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডেরও সদস্য তিনি।

তিনি গত প্রায় মাসখানেক ধরে তার টুইটার ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে ঘটে যাওয়া নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে একের পর এক পোস্ট করে চলেছেন – সঙ্গে তখনকার বিখ্যাত 'বন্দে মাতরম' পত্রিকার মাস্টহেডে সেগুলোকে শিরোনামের আকারে সাজিয়ে।

এর কোনওটায় তিনি লিখেছেন : 'লক্ষ্মীপুজোর রাতে হিন্দু গণহত্যা সংঘটিত হয় গোলাম সারওয়ার ও তার ভাই ছোট মিঁয়ার ষড়যন্ত্রে'।

কোনওটায় আবার জানাচ্ছেন, 'গোলাম সরকারের হাড় হিম করা ফতোয়া : সুচেতা কৃপালনীকে ধর্ষণ করলেই মিলবে 'গাজী' খেতাব!'

প্রসঙ্গত, সুচেতা কৃপালনী ছিলেন মোহনদাস গান্ধীর অনুগামী তরুণ কংগ্রেস নেত্রী, যিনি দাঙ্গা ঠেকানোর মিশন নিয়ে তখন নোয়াখালীতেই।

অন্য দিকে গোলাম সারোয়ার হুসেইনি তখন ছিলেন নোয়াখালীর শ্যামপুর দায়রা শরীফের গদ্দিনশীর পীর এবং নোয়াখালি কৃষক সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী মুসলিম নেতা।

ছেচল্লিশের নোয়াখালী দাঙ্গা নিয়ে বিবেক অগ্নিহোত্রীর পোস্ট

ছবির উৎস,Vivek Agnihotri/X

ছবির ক্যাপশান,ছেচল্লিশের নোয়াখালী দাঙ্গা নিয়ে বিবেক অগ্নিহোত্রীর পোস্ট

বিবেক অগ্নিহোত্রী আর একটি পোস্টে লিখেছেন : 'নোয়াখালীতে কংগ্রেস নেতার বাড়িতে হামলা করে তার ছেলেকে খুন, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো দলের অফিস'। এবং এরকম আরও অজস্র।

কিন্তু এত পুরনো একটি ঘটনা নিয়ে আচমকা পরিচালকের এই আগ্রহের কারণ কী?

আসলে 'ফাইলস ট্রিলজি'-তে বিবেক অগ্নিগোত্রীর তৃতীয় ছবি 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' ভারতে মুক্তি পেতে যাচ্ছে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর, সেই ছবির প্রচার ও প্রোমোশনের জন্যই এই তুমুল সোশ্যাল মিডিয়া ক্যামপেইন।

আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এই ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, ভারতেও ছবির আনুষ্ঠানিক ট্রেলার লঞ্চ করা হয়েছে গত ১৬ অগাস্ট – উনআশি বছর আগে যে দিনটিতে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় মুসলিম লীগ 'ডাইরেক্ট অ্যাকশনে'র ডাক দিয়েছিল।

বিবেক অগ্নিহোত্রী ছবিটি তৈরিই করেছেন ভারতে দেশভাগের ঠিক আগের বছর যেভাবে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গায় ('দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং') হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং সেই দাঙ্গার ঝড় আছড়ে পড়েছিল নোয়াখালীতে – সেই মর্মান্তিক কাহিনি নিয়ে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, ওই রাজ্যে ছবিটিকে কোনও সিনেমা হলেই প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হবে না – অগ্নিহোত্রী যার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর সরকার বেঙ্গল ফাইলসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর সরকার বেঙ্গল ফাইলসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে

অন্য দিকে ছবিটিকে সব রকমভাবে সমর্থন জানাচ্ছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি – যারা বলছে এই ছবিটির মাধ্যমে দেশভাগের সময় বাংলার হিন্দুদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, যা এতদিন রূপালী পর্দায় কেউ বলার সাহসই দেখাতে পারেননি।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের আবার যুক্তি, সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দিয়ে এই সিনেমাটি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিবেশ বিষিয়ে তুলতে চাইছে – এবং আগামী বছর (২০২৬) রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই ছবিটি কেন মুক্তি পাচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যটাও বোঝা কঠিন নয়।

ছবিটি ভারতে এখনও মুক্তি না পেলেও পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতিরও অভিযোগ এনেছেন কেউ কেউ, এমন কী ছবির ট্রেলারের বিরুদ্ধেও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।

পাশাপাশি 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' নির্মাতাদের পাশে দাঁড়িয়েও অনেকে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, যে বাংলা বাকস্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তা নিয়ে এতো গর্ব করে – সেখানে কেন একজন পরিচালক তার সিনেমা দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পারবেন না?

সব মিলিয়ে 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে – আর এই আবহেই আবার সামনে চলে এসেছে ঠিক উনআশি বছর আগে অবিভক্ত বাংলার বুকে এক রক্তাক্ত ইতিহাস।

ছবিটি নিয়ে এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে

গত বছর যখন এই ছবিটি তৈরির কাজ শুরু হয়, তখন এটির নাম ছিল 'দিল্লি ফাইলস' – পরে নির্মাতারা এর নাম পাল্টে রাখেন 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস', কারণ বাংলাই এই গল্পের প্রধান পৃষ্ঠভূমি।

পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী

ছবিটিতে অভিনয় করেছেন মিঠুন চ্যাটার্জি, অনুপম খের, পল্লবী জোশী, শাশ্বত চ্যাটার্জি, প্রিয়াংশু চ্যাটার্জি, দর্শন কুমারের মতো তারকারা – আর কলকাতায় 'গোপাল পাঁঠা' নামে যে চরিত্রটি দাঙ্গার সময় হাজার হাজার হিন্দুর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন বলে বলা হয়, সেই ভূমিকায় আছেন অভিনেতা সৌরভ দাস।

ছবিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর সৌরভ দাস সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিনি চুক্তি করেছিলেন 'দিল্লি ফাইলসে' অভিনয়ের জন্য – আর শুধু নিজের অংশটার চিত্রনাট্যই তার জানা ছিল, পুরো সিনেমার কাহিনি কী সেটা নিয়ে তার না কি কোনও ধারণাই ছিল না!

ছবির অভিনেতারা কেউ কেউ এখন অস্বস্তিতে পড়লেও 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' ইতিমধ্যে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়ে গেছে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাকি দেশের সিনেমা হলগুলোতে দিন পনেরোর মধ্যেই এটি মুক্তি পাচ্ছে সেটাও নিশ্চিত।

এর আগে প্রায় মাসখানেক ধরে নিউ জার্সি, শিকাগো, সান হোসে, সানফ্রান্সিসকো-সহ মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহরে ছবিটির বিশেষ প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়েছে – যেখানে প্রচুর সংখ্যায় ভারতীয় দর্শক উপস্থিত ছিলেন।

শিকাগোতে ছবির প্রিমিয়ারে ভারতের কনসাল জেনারেল সোমনাথ ঘোষও উপস্থিত ছিলেন, 'দ্য বেঙ্গল ফাইলসে'র দিকে 'সাহায্যের হাত' বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরিচালক তাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদও জানিয়েছেন।

বিবেক অগ্নিহোত্রীর ছবিতে ভারত সরকারের 'সাহায্য' অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয় – বস্তুত তার আগের ছবি 'দ্য কাশ্মীর ফাইলসে'র হয়ে 'প্রোমোশন' করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে, তিনি দেশবাসীকে ছবিটিকে দেখার জন্য প্রকাশ্যে আহ্বানও জানিয়েছিলেন।

শিকাগোতে ছবির প্রিমিয়ারে ভারতের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে ছবির নির্মাতারা

ছবির উৎস,Vivek Agnihotri/X

ছবির ক্যাপশান,শিকাগোতে ছবির প্রিমিয়ারে ভারতের কনসাল জেনারেলের সঙ্গে ছবির নির্মাতারা

বহু সমালোচক সেই ছবিটিকে 'ইসলামোফোবিক' ও প্রোপাগান্ডা-মূলক বলে বর্ণনা করলেও কাশ্মীরি পন্ডিতদের ওপর অত্যাচারের সেই বিবরণ বিজেপি-শাসিত প্রায় সব রাজ্যেই করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।

তবে 'দ্য বেঙ্গল ফাইলস' কিন্তু এবারে পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রবল রাজনৈতিক বাধার মুখে পড়েছে।

গত ১৬ অগাস্ট কলকাতার একটি মাল্টিপ্লেক্স চেইনে ছবিটির ট্রেলার লঞ্চ করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে 'রাজনৈতিক চাপে'র কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ সে অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়। অন্তত পরিচালক নিজে সে রকমই জানিয়েছেন।

পরে শহরের একটি পাঁচতারা হোটেলে সে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও কলকাতা পুলিশ মাঝপথে ঢুকে সেখানেও বাধা দেয় – এবং পর্দায় ট্রেলার দেখানোর আগেই পাওয়ার কেবল-এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। জব্দ করা হয় নির্মাতাদের একটি ল্যাপটপও।

পুলিশ পরে জানায়, এ ধরনের অনুষ্ঠানে কোনও ফিল্মের ট্রেলার দেখানোর জন্য আয়োজকদের যে 'বিনোদন লাইসেন্স' থাকার কথা সেটা তারা দেখাতে পারেননি।

বিবেক অগ্নিহোত্রী পাল্টা অভিযোগ করেন, 'সত্যজিত রায়ের শহরে আসার পরেও' এভাবে যে একজন চিত্র পরিচালকের কণ্ঠরোধ করা হতে পারে, তা তিনি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেননি।

অভিনেতা অনুপম খের ও বিজেপি নেতা স্বপন দাশগুপ্তর সঙ্গে পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,অভিনেতা অনুপম খের ও বিজেপি নেতা স্বপন দাশগুপ্তর সঙ্গে পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী

এই ঘটনা নিয়ে যথারীতি রাজনৈতিক দোষারোপ ও পাল্টা দোষারোপও শুরু হয়ে গেছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ সটান জানিয়ে দিয়েছেন, "পশ্চিমবঙ্গে বেঙ্গল ফাইলস দেখানো যাবে না – কারণ প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বানিয়ে রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা রাজ্য সরকার কিছুতেই মেনে নেবে না।"

শুধু তাই নয়, পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন – "বেঙ্গল ফাইলস বানানোর আগে গুজরাট দাঙ্গার সময় ধর্ষিতা বিলকিস বানানোর ঘটনা নিয়ে 'গুজরাট ফাইলস', কিংবা উত্তর প্রদেশের হাতরাস বা উন্নাও-এর নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে 'ইউপি ফাইলস' আগে বানান ... তারপর না হয় বাংলায় ঢোকার সাহস দেখাবেন!"

দিল্লিতে দক্ষিণপন্থী চিন্তাবিদ ও অ্যাকাডেমিক আনন্দ রঙ্গনাথন ওদিকে টুইট করেছেন, "ছবি মুক্তির আগেই বেঙ্গল ফাইলসের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে একগুচ্ছ এফআইআর!"

"এ ছবি না কি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াবে। বেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধারক ও বাহকরা এখন কোথায় গেলেন?"

'এ লড়াই'তে বিবেক অগ্নিহোত্রীর পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন মি রঙ্গনাথন, তার পোস্ট রিটুইট করেছেন ছোট-বড়ো বহু বিজেপি নেতাই।

ছবিটি যাতে কলকাতায় দেখানো হয়, সেই দাবিতে ‘জয় মা কালী ধর্মসেনা’র মিছিল

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ছবিটি যাতে কলকাতায় দেখানো হয়, সেই দাবিতে 'জয় মা কালী ধর্মসেনা'র মিছিল

কলকাতায় ছবি নিয়ে এই সব তুলকালামের পর দিল্লিতে ফিরে এসে সোমবার (১৮ অগাস্ট) একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন বিবেক অগ্নিহোত্রী-সহ ছবির প্রযোজকরা।

দিল্লির সাংবাদিক সম্মেলনে মি অগ্নিহোত্রী জানান, মমতা ব্যানার্জীর সরকার তার ফিল্মের বিরুদ্ধে যে সব আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে বা এফআইআর করেছে, আইনি পথেই তার মোকাবিলা করা হবে।

"আমরা দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে সংবিধান মেনেই এগোব, এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষও যাতে ছবিটি দেখতে পারে তার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাব",. জানান তিনি।

দিল্লিতে প্রযোজক সংস্থার সূত্রগুলি বিবিসিকে আভাস দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি শেষ পর্যন্ত রাজ্যের সিনেমা হলগুলোতে ছবিটি দেখাতে না দেয় – তাহলে নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন প্রাইমের মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দ্রুত ছবিটিকে আনার ব্যবস্থা করে তারা যে করেই হোক পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ছবিটি দেখাবেন।

ফিল্মে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠছে কেন?

এই সিনেমার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গোপাল পাঁঠার, যাকে দাঙ্গার সময় কলকাতায় 'হিন্দুদের রক্ষাকর্তা' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ছবির ট্রেলার থেকেও সে রকমই আভাস মিলেছে।

গোপাল পাঁঠা ওরফে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের বর্তমান প্রজন্মের উত্তরাধিকারীরা অভিযোগ করেছেন, ছবিটিতে তাকে যেভাবে একজন 'মুসলিম-বিদ্বেষী কসাই' হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, সেটা কোনো মতেই মানা যায় না।

গোপাল পাঁঠার স্মরণে এ বছর কলকাতায় ১৬ অগাস্ট পদযাত্রার ডাক

ছবির উৎস,Shubhendu Adhikari/X

ছবির ক্যাপশান,গোপাল পাঁঠার স্মরণে এ বছর কলকাতায় ১৬ অগাস্ট পদযাত্রার ডাক

গোপাল পাঁঠার পৌত্র শান্তনু মুখার্জি দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকাকে বলেছেন, তার পিতামহ দাঙ্গার সময় বহু মুসলিমেরও প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং বহু মুসলিমের সঙ্গেই তার দারুণ সম্পর্ক ছিল।

বিবেক অগ্নিহোত্রী অবশ্য পাল্টা জবাব দিয়েছেন, শান্তনু মুখার্জী একজন 'তৃণমূলের লোক' এবং দলের লাইন মানার বাধ্যবাধকতা থেকেই তাকে ওই মন্তব্য করতে হয়েছে।

তবে মি অগ্নিহোত্রীর 'অতীত ট্র্যাক রেকর্ড' যা, তাতে তার ছবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ থেকে যায় বলেই কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের অভিমত।

তা ছাড়া দেশভাগের আগে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার বিষয়টি আজও এতই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল একটি ইস্যু – সেটি খুব সতর্কতা ও সাবধানতার সঙ্গে 'ডিল' করা উচিত বলেও অনেকে মনে করেন।

দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুকল্যাণ গোস্বামীর কথায়, "কাশ্মীর ফাইলসেও বহু জায়গাতেই তিনি সত্যের অপলাপ করেছেন, বা হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছেন।"

যখন একজন পরিচালক সমকালীন ইতিহাসের কোনো ঘটনা নিয়ে ছবি বানান, তখন নির্মাতার স্বাধীনতার নামে তার এরকম তথ্য বিকৃতির অধিকার থাকে না বলেই মি গোস্বামীর অভিমত।

দ্য কাশ্মীর ফাইলসের প্রচারে বিবেক অগ্নিহোত্রী ও তার অভিনেত্রী স্ত্রী পল্লবী জোশী (ফাইল ছবি)

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,দ্য কাশ্মীর ফাইলসের প্রচারে বিবেক অগ্নিহোত্রী ও তার অভিনেত্রী স্ত্রী পল্লবী জোশী (ফাইল ছবি)

তা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে এর আগেও মি অগ্নিহোত্রী নানা ধরনের 'ভুল তথ্য' ছড়িয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যার কোনো কোনোটি তাকে প্রত্যাহারও করতে হয়েছে।

বিবিসির নাম দিয়ে একটি অস্তিত্ত্বহীন জরিপকে উদ্ধৃত করে কংগ্রেসকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দল হিসেবে দাবি করা, রাজনীতিবিদ কানহাইয়া কুমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন – এরকম নানা পোস্ট তাকে আগেও অস্বস্তিতে ফেলেছে।

তবে তিনি যে ছবি বানান 'হিন্দু সভ্যতার দৃষ্টিকোণে' – সোমবার দিল্লির সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তা সোজাসুজি স্বীকার করে নিয়েছেন এবং বলতে চেয়েছেন, সে কারণেই অন্য ইতিহাসবিদদের সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গীর ফারাক থাকতেই পারে।

বিবেক অগ্নিহোত্রীর কথায়, "আমি হিন্দুদের ইতিহাস নিয়ে ছবি বানাই, কারণ ইসলাম বা খ্রীষ্টানদের ইতিহাস নিয়ে ছবি বানানোর কোনও ক্ষমতা আমার নেই, দক্ষতাও নেই!"

"কাশ্মীরে ইসলামি ইতিহাসের দৃষ্টিকোণে মণিরত্নম 'রোজা' বানিয়েছেন, কিংবা বিশাল ভরদ্বাজ 'হায়দার'। আমি হিন্দু ইতিহাসের দৃষ্টিতে কাশ্মীর ফাইলস বানিয়েছি – ব্যাস এটুকুই।"

বামপন্থী ইতিহাসবিদরাও অনেকেই 'দ্য বেঙ্গল ফাইলসে'র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান, তবে তারা জোর করে ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করার বিপক্ষে।

কেরালার সিপিএম সাংসদ জন ব্রিটাস বিবিসিকে বলছিলেন, "ছবিতে যাই থাকুক, আমার মতে দর্শক নিজেরাই সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নিন। যদি সেটা বিদ্বেষমূলক কিছু হয়, আমি নিশ্চিত বাংলার দর্শক নিজেরাই সেটা বর্জন করবেন।"গত বছর ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি নিয়েও ভারতে অনেকটা একই ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছিল

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,গত বছর 'দ্য কেরালা স্টোরি' ছবিটি নিয়েও ভারতে অনেকটা একই ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছিল

সাম্প্রতিক কালে কেরালার মুসলিমদের 'দলে দলে' আইসিসে যোগদান নিয়ে বানানো আর একটি ছবি 'দ্য কেরালা স্টোরি'কেও প্রোপাগান্ডা মুভির তকমা দেওয়া হয়েছিল – কিন্তু খোদ কেরালাতেই কিন্তু সেটি নিষিদ্ধ করা হয়নি, মনে করিয়ে দিচ্ছেন মি ব্রিটাস।

এই বিতর্কে আবার অন্য একটা মাত্রা দিচ্ছেন বেঙ্গল ফাইলসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেতা শাশ্বত চ্যাটার্জি।

নিজের ভূমিকার সমর্থনে তার যুক্তি, একজন অভিনেতা ভাল চরিত্র পেলে করবেনই – ছবির গল্পে ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে কি না, সেটা দেখা তার কাজ নয়।

শাশ্বত চ্যাটার্জি বলছেন, "আমি ইতিহাসবিদ নই যে বলতে পারবো এই ছবিতে সত্যি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে কি না। একজন অভিনেতা হিসেবে সেটা আমার দায়িত্বও নয়।"

"যারা মনে করছেন এই ছবিতে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, অথবা বাংলার অমর্যাদা করা হয়েছে – তারা ছবিটির বিরুদ্ধে চাইলে আদালতে যেতে পারেন", মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের এই জনপ্রিয় অভিনেতা।

দ্য বেঙ্গল ফাইলস ভারতে মুক্তি পেতে এখনো দু'সপ্তাহের ওপর বাকি – কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই ইতিহাস, বাকস্বাধীনতা বা রাজনীতির প্রশ্নে এই ছবিটিকে নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্ক শুরু হয়েছে সাম্প্রতিককালে প্রায় নজিরবিহীন!