মানবজাতি ও মানবসভ্যতার অপরিহার্য অংশ নারী। সভ্যতার অংশীদার নারীও পুরুষের মতো সম্মান ও মূল্যায়নের দাবি রাখে। ইসলাম নারীকে কাঙ্ক্ষিত সেই মর্যাদা দান করেছে। তাই ইসলামের সূচনাকাল থেকে নারীও শামিল হয়েছে দ্বিনি কার্যক্রমের সঙ্গে।
নবীজি (সা.) দ্বিনি দাওয়াত, ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা, সামাজিক মর্যাদা ও দ্বিন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীকে অংশীদার করেছেন। তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কারণে নারী সাহাবিরাও বীরত্ব ও সাহসিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মহানবী (সা.) ওহি লাভের পর সাইয়েদা খাদিজাতুল কুবরা (রা.) প্রথম মানবসন্তান হিসেবে ইসলাম গ্রহণ এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সহযোগী হওয়ার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় তিনি ছিলেন কুণ্ঠাহীন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুসলমানদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতন। এই নির্যাতনের মুখে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেন তাতেও অংশীদার ছিলেন নারীরা, বরং তাঁরা সব পুরুষকে পেছনে ফেলে শাহাদাতের প্রথম সুধা পান করেছিলেন; প্রথম শাহাদাতবরণকারী ছিলেন সুমাইয়া (রা.)। তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ। ইসলামের প্রশ্নে যখন মাতৃভূমি ত্যাগের প্রয়োজন হয় তখন পুরুষ সাহাবিদের কাফেলায় যোগ দেন নারী সাহাবিরাও।
মুসলমানরা প্রথমবার মক্কা থেকে হাবশায় হিজরত করেন। হাবশার প্রথম হিজরতে শরিক ছিলেন নবীজি (সা.)-এর আদরের কন্যা রোকাইয়া (রা.), উম্মে সালামা (রা.), লায়লা বিনতে হাসমা (রা.) ও সাহলা বিনতে সুহাইল (রা.)।
মদিনায় হিজরত করার পর মহানবী (সা.) যখন ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন, তখন নারী সাহাবিরাও ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা পুরুষের মতো যুদ্ধের ময়দানে বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রমাণ রাখেন, বরং নারী সাহাবিদের অনেকে বীরত্বের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
হুনাইনের যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনী সাময়িক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল, তখন অনেক যোদ্ধা যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করেছিল।
খন্দকের যুদ্ধের সময় নবীজি (সা.) নারীদের একটি নিরাপদ দুর্গে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তখন দুর্গের পাশে একজন ইহুদি ঘোরাফেরা করছিল। সাফিয়্যা (রা.) তাকে চিনতে পারেন এবং তাঁবুর খুঁটি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন।
উম্মে আম্মারা (রা.) ছিলেন একজন বিখ্যাত নারী সাহাবি। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আসার আগে মদিনাবাসী সাহাবিদের কাছ থেকে আকাবা নামক স্থানে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন তাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধের সময় যখন মুসলিম বাহিনী ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল এবং কাফিররা সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর হামলা করছিল, তখন একদল সাহাবি তাঁর জীবন রক্ষার জন্য নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন। উম্মে আম্মারা (রা.) ছিলেন সেই জীবন উৎসর্গকারী সাহাবিদের একজন। তিনি মহানবী (সা.)-কে আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহতও হন।
অন্যান্য যুদ্ধেও তিনি বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি নজিরবিহীন সাহসিকতার প্রমাণ রাখেন। এই যুদ্ধে তাঁর হাতে গুরুতর আঘাত পাওয়ার আগ পর্যন্ত বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। ষষ্ঠ হিজরিতে যখন মহানবী (সা.) হজের নিয়তে মক্কার উদ্দেশে বের হন এবং মক্কার পরিস্থিতি জানতে উসমান (রা.)-কে সেখানে পাঠান, তখন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল যে উসমান (রা.) কুরাইশের হাতে শহীদ হয়েছেন। তখন নবীজি (সা.) উপস্থিত সাহাবিদের কাছ থেকে কুরাইশের যুদ্ধে আমরণ যুদ্ধের শপথ গ্রহণ করেছিলেন, ইসলামের ইতিহাসে যা বায়াতে রিদওয়ান নামে পরিচিত। এই শপথেও অংশগ্রহণ করেছিলেন উম্মে আম্মারা (রা.)।
উম্মে জিয়াদ আশজাইয়্যা (রা.) অন্য পাঁচজন নারী সাহাবিকে নিয়ে খায়বারের ময়দানে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করেন। তাঁর তীর কুড়িয়ে সেনাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। উম্মে আতিয়্যা (রা.) মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশ নেন এবং সেনাদের জন্য খাবার রান্না করেন।
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনামলে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল কাদেসিয়ার যুদ্ধ। ভয়াবহ এই যুদ্ধ ইতিহাসের বাঁক বদল করে দিয়েছিল। কাদেসিয়ার যুদ্ধে প্রসিদ্ধ আরব কবি ও নারী সাহাবি খানসা (রা.) নিজের চার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে অংশ নেন। রাতের প্রথম অংশে যখন সৈনিকরা ভয়াবহ সকালের অপেক্ষা করছিল, তখন তিনি তাদের অন্তরে কবিতার আগুন জ্বেলে দেন। তিনি তাঁর ছেলেদের উদ্দেশে আবৃত্তি করেন, ‘প্রিয় পুত্র আমার! তোমরা নিজ ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছ, নিজ ইচ্ছায় হিজরত করেছ। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর কসম, তোমরা এক মায়ের সন্তান এবং এক বাবার পুত্র। আমি তোমাদের বাবার বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি, তোমাদের মাতামহদের অসম্মান করিনি, কলঙ্কিত করিনি তোমাদের রক্তের ধারাকে। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে বিনিময় আল্লাহ রেখেছেন তা তোমরা জানো। তোমরা আরো জানো চিরস্থায়ী জান্নাত ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং সদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ২০০)
আগামীকাল সকালে যদি তোমরা কল্যাণের সঙ্গে উপনীত হও, তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করবে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে। তোমরা সর্বাত্মক যুদ্ধে উপনীত হবে, যেখানে যুদ্ধের আগুন প্রকট হবে সেখানে তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং গনিমতের মাল ছিনিয়ে আনবে। যেন তোমরা দুনিয়ায় গনিমতের সম্পদ পেয়ে সমৃদ্ধ হও অথবা পরকালীন সম্মান লাভ করো।
সকালে খানসা (রা.)-এর চার ছেলে একযোগে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বীরবিক্রমে লড়াই করে শহীদ হয়ে যান। খানসা (রা.) ছেলেদের শহীদ হওয়ার সংবাদ পেয়ে বলেন, সব প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি ছেলেদের শাহাদাতের মাধ্যমে আমাকে সম্মানিত করেছেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধে উম্মে হাকিম বিনতে হারিস (রা.) বিশেষ বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখান। তিনি একাই ৯ জন রোমান সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ সেনাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল।