সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে গত দুই-তিন দিনই ভালো কোনও খবর দিতে পারেননি চিকিৎসকরা। যতবারই ব্রিফিং করেছেন, বলা হয়েছে তার অবস্থা সংকটাপন্ন। সর্বশেষ সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে মেডিক্যাল বোর্ডের তৎপরতা বেশ বেড়ে যায়।
রাত ১০টা ১০ মিনিটে হাসপাতালে পৌঁছান খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মাকে দেখে রাত ১টা ৫৪ মিনিটে পরিবারের সদস্যসহ হাসপাতাল ত্যাগ করেন তিনি। পরে আবার হাসপাতালে আসেন তিনি। এদিন একাধিকবার হাসপাতালে আসেন তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান।
এদিন হাসপাতালে আসেন খালেদা জিয়ার বড় বোন সেলিনা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান, আরাফাত রহমান কোকোর মেয়ে জাহিয়া রহমান। রাত ১০টা ২৩ মিনিটে হাসপাতালে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
হাসপাতাল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এএসএফ), প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপস্থিত ছিলেন। কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে হাসপাতালের প্রধান ফটক ঘিরে ফেলা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সের (সিএসএফ) সদস্যরাও নিরাপত্তায় ছিলেন।
রাত সোয়া ২টায় মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন।
এরপর মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে জানানো হয়, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই।
এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই দেশ-বিদেশে দলমত নির্বিশেষে সবাই শোকাহত হন। ফেসবুক শোকে ছেয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা একে একে শোক প্রকাশ করেন।
সকাল সাড়ে ৮টায় এভার কেয়ার হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মির্জা ফখরুল বলেন, “জাতি অভিভাবক হারালো। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।”
এ সময় দলের পক্ষ থেকে সাত দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেন রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মৃত্যুর খবরে সকাল থেকেই ছুটে আসেন দলীয় নেতাকর্মীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকারণ্য হয়ে পড়ে হাসপাতালের সামনের দুই রাস্তা। সবার চোখে মুখে শোকাবহ চিত্র। অনেকে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
শুধু সাধারণ মানুষই নন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও ছুটে যান হাসপাতালে। রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি ক্রীড়া ও বিনোদন অঙ্গনেও শোকের ছায়া নেমে আসে।
সরকারের পক্ষ থেকে সকাল সাড়ে ১০টায় ক্যাবিনেট বৈঠক ডাকা হয়। এতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, খালেদা জিয়ার শেষ বিদায়ের সব আয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে সম্পন্ন করা হবে। জানানো হয়, বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তার জানাজা শেষে জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে তার দাফন হবে। দুপুর ১২টায় রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানান, বুধবার সাধারণ ছুটি ও তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মৃত্যুর সংবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
দলীয় করণীয় নির্ধারণে দুপুর আড়াইটায় গুলশানের কার্যালয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানের সভাপতিত্বে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
মায়ের মৃত্যুতে দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে আবেগঘন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মৃত্যুর সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমেও গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানরাও শোকপ্রকাশ করেন। এছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারাও শোক প্রকাশ করেন। বন্ধ রাখা হয় আদালতসহ বিভিন্ন অফিসের কার্যক্রম৷
বিএনপির গুলশানের কার্যালয়ে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা শোক বইয়ে সই করেছেন। এছাড়াও রাজনৈতিক নেতারাও তাদের জন্য নির্ধারিত শোক বইয়ে সই করেছেন।
সবমিলিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে জাতি এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হচ্ছে। যেখানে একজন সাবেক সরকার প্রধান সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসা নিয়ে শেষ বিদায় নিতে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)'র সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আমাদের দেশের একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ ছিলেন। ৮০'র দশকে প্রতিকূল পরিবেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখেন। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে যুগপৎ আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রাখেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সোচ্চার ছিলেন। সেই থেকেই মূলত আপসহীন নেত্রীর উপাধি পেয়েছিলেন। তবে দেশের একটি ক্রান্তিকালে তার চলে যাওয়া এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করলো। আমি মনে করি, ৫ আগস্টের পর রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা বা উগ্র মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে, বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি সক্রিয় থাকলে হয়তো এমনটি হতো না। আমরা মনে করি, বেগম জিয়ার সংগ্রামী মনোভাব ও পরিশীলিত রাজনীতির কারণে জীবনের শেষ বিদায়েও দেশবাসীর ভালোবাসা পাচ্ছেন।”
বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বেগম খালেদা একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি আজীবন দেশ ও জাতির জন্য লড়াই করে আপসহীন নেত্রীর মর্যাদা পেয়েছেন। তাই মৃত্যুতেও তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার ভালোবাসা পেয়েছেন।”
অন্তিম মুহূর্তে পাশে ছিলেন আপনজনরা
এভারকেয়ার হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়ার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় জ্যেষ্ঠ ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান, নাতনি জাইমা রহমান, ছোট ছেলের বউ শামেলি রহমান সিঁথি, ছোট ভাই শামীম এসকান্দার, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ সব আত্মীয়স্বজন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
ক্লিনিক্যাল ডেড জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদার
সকালে এভারকেয়ারে সংবাদ সম্মেলন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শাহাবুদ্দিন তালুকদার। তিনি জানান, ভোর ৬টায় বেগম খালেদা জিয়াকে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা করা হয়।
তিনি বলেন, “গত ২৩ নভেম্বর অসুস্থতা নিয়ে বেগম জিয়া এভারকেয়ারে হাসপাতালে ভর্তি হন। বিগত এক মাস দশ দিন তার চিকিৎসায় আমাদের টিম আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। যেন মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করেন।”
তারেক রহমানের আবেগঘন স্ট্যাটাস
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুক পোস্টে বলেন, “আমার মায়ের প্রতি দেশবাসীর আবেগ, ভালোবাসা ও বৈশ্বিক শ্রদ্ধায় আমি ও আমার পরিবার চিরকৃতজ্ঞ। আপনারা আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।”
তারেক রহমান বলেন, “অনেকের কাছে তিনি ছিলেন দেশনেত্রী, আপসহীন নেত্রী; অনেকের কাছে গণতন্ত্রের মা, বাংলাদেশের মা। আজ দেশ গভীরভাবে শোকাহত এমন একজন পথপ্রদর্শককে হারিয়ে, যিনি দেশের গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় অনিঃশেষ ভূমিকা রেখেছেন “
তিনি বলেন, “আমার কাছে খালেদা জিয়া একজন মমতাময়ী মা, যিনি নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ ও মানুষের জন্য। আজীবন লড়েছেন স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে; নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।”
তারেক রহমান আরও বলেন, “ত্যাগ ও সংগ্রামে ভাস্বর হয়েও, মা ছিলেন পরিবারের সত্যিকারের অভিভাবক; এমন একজন আলোকবর্তিকা যার অপরিসীম ভালোবাসা আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়েও শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, সর্বোচ্চ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তবুও যন্ত্রণা, একাকিত্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও তিনি অদম্য সাহস, সহানুভূতি ও দেশপ্রেম সঞ্চার করেছিলেন পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও উল্লেখ করেন, “দেশের জন্য তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) হারিয়েছেন স্বামী, হারিয়েছেন সন্তান। তাই এই দেশ, এই দেশের মানুষই ছিল তার পরিবার, তার সত্তা, তার অস্তিত্ব। তিনি রেখে গেছেন জনসেবা, ত্যাগ ও সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিক্রমায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
মায়ের জন্য দোয়া চেয়ে তিনি লিখেন, “আপনারা সবাই আমার মা’র জন্য দোয়া করবেন। তার প্রতি দেশবাসীর আবেগ, ভালোবাসা ও বৈশ্বিক শ্রদ্ধায় আমি ও আমার পরিবার চিরকৃতজ্ঞ।”
ভাষণ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা, তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও বুধবার সাধারণ ছুটি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত (৩১ ডিসেম্বর এবং ১ ও ২ জানুয়ারি) তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) সারা দেশে সাধারণ ছুটি থাকবে।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ এ তথ্য জানান।
পরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
জকসু নির্বাচন স্থগিত
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো রেজাউল করিম সিন্ডিকেট মিটিং শেষে এ তথ্য জানান।
এদিন সকাল ৯টায় ভোট গ্রহণ শুরুর নির্দেশনা থাকলেও বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়। এ সময় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন স্থগিত করার কথা জানায় প্রশাসন। যদিও এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীদের একাংশ।
হাসপাতালের সামনে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে সকাল থেকেই রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভিড় বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনেকে। হাসপাতালের সামনের দুই পাশের রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।
এ ভিড় সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও দলীয় স্বেচ্ছাসেবকদের হিমশিম খেতে হয়েছে। মানুষের চাপে উভয় পাশে যান চলাচল কিছুটা ব্যাহত হয়।
অনেকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের ছবি প্রদর্শন করেন। কেউ কেউ ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সাধারণ নেতাকর্মী ছাড়াও দলের নেতারাও হাসপাতালে ছুটে আসেন।
হাসপাতালে ছুটে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন ফারুক, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন আপসহীনতার প্রতীক। অন্যায়ের কাছে তিনি কখনও মাথা নত করেননি। তারা তার জন্য দেশবাসীর দোয়া কামনা করেন।
প্রথমবার তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠক
বিএনপির চেয়ারপারসনের মৃত্যুতে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। হাসপাতালে মা খালেদা জিয়ার মরদেহ রেখে এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রথমবারের মতো তিনি সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার জানাজা নামাজ বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপু ২টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে হবে। নামাজ পড়াবেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব। এরপর খালেদা জিয়াকে স্বামী শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে তার পাশে দাফন করা হবে। জানাজায় শৃঙ্খলা মেনে সবাইকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
গুলশান কার্যালয়ে শোক বইয়ে কূটনীতিকদের সই
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দলটির গুলশান কার্যালয়েশোক বইয়ে সই করছেন বন্ধুপ্রতীম বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।
সই করা দেশগুলোর মধ্যে মধ্যে চীন, ভারত, পাকিস্তান জার্মান, ইরান, ওমান, আলজেরিয়া, কাতার, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন, ব্রুনাই, ফিলিস্তিন, স্পেন, মরক্কো, ভুটান ও ব্রাজিলসহ ২৮টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা রয়েছেন।
বুধ এবং বৃহস্পতিবারও সই কার্যক্রম চলবে বলে জানানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বুধবার দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সব ধরনের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
শোক প্রকাশ করেছেন যারা
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)'র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ বি়ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিশ্ব পরিমণ্ডলেও শোকের ছায়া
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ বিশ্ব নেতাদের অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন।
ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়।
শোক জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা।
শোকবার্তায় তারা খালেদা জিয়ার সরকারের সময় দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি। শোক জানিয়েছেন, পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
এদিকে, ভারতের সরকার ও জনগণের পক্ষে শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় আসছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। তিনি বুধবার ঢাকায় পৌঁছাবেন বলেও জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে বুধবার সকালে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের পার্লামেন্টের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিক।
জানাজার জন্য প্রস্তুত মানিক মিয়া এভিনিউ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন স্বামীর কবরের পাশে
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে দাফন করা হবে। দাফন ও সংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিকতায় নিরাপত্তাজনিত কারণে জিয়া উদ্যানে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দুপুর ২টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বিকাল সাড়ে ৩টায় চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে তাকে।
শুধু আমন্ত্রিত ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্টদের অনুমতি দেওয়া হবে দাফনের সময় প্রবেশে। এছাড়া, নিরাপত্তার স্বার্থে জানাজা ও দাফন স্থলে কোনও ধরনের ব্যাগ বা ভারী সামগ্রী বহন না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে প্রেস উইং।
উল্লেখ্য, ৮০ বছর বয়সি খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের অধীনে তার চিকিৎসা কার্যক্রম চলছিল।