বেগম খালেদা জিয়া একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ছিলেন রাজনীতির অভিভাবক। পুরো বাংলাদেশটাই ছিলো তাঁর পরিবার। যিনি ক্ষমতার মসনদ থেকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠ, সবই দেখেছেন, কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে একচুলও নড়েননি। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে মনে রাখবে তাঁর ত্যাগের জন্য, তাঁর সাহসের জন্য, এবং দেশের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক বিশাল কর্মময় জীবন। লড়াই এবং সংগ্রামের ইতিহাস। বার বার নির্যাতিত নির্বাসিত হয়েছিলেন। দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিলো। তবুও তিনি দেশ ছেড়ে , এই দেশের মাটি ও মানুষকে রেখে বিলাসী জীবণ কিংবা পালিয়ে যাননি। দেশের জন্য, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সব সময় লড়ে গিয়েছেন।
“দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি মানুষই আমার সবকিছু”, এই আবেগমাখা উচ্চারণ ছিল বেগম খালেদা জিয়ার। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, তিনবারের সরকার প্রধান ও উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একজন। তিনি গতকাল সবাইকে কাঁদিয়ে আসমানের মালিকের কাছে চলে গিয়েছেন।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নির্বাচনী জনসভার শেষ দিনে এক নারী কণ্ঠে উচ্চারিত দেশ রক্ষার ঐতিহাসিক বাক্য। যা পরবর্তী তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই তেজস্বী কণ্ঠে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন- ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা’। সেই ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে শুরু করে আজীবনের আপসহীন সংগ্রাম করে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের এক জীবন্ত প্রতীক।
১৯৯০-এর শেষ দিকে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতনের পর দেশ যখন নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, তখন রাজনৈতিক মেরুকরণ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। সেই নির্বাচনী প্রচারণার শেষ পর্যায়ে বেগম জিয়া তার ভাষণে রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, একপক্ষ বিদেশের শক্তির কাছে নতজানু হয়ে গোলামির জিঞ্জির পরে আছে, আর অন্যপক্ষ সাধারণ মানুষের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে স্বাধীনতার পতাকাকে সমুন্নত রাখতে চায়।এই একটি বাক্য দিয়েই তিনি সে সময়কার তরুণ প্রজন্ম ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের মনে জাতীয়তাবাদের বীজ বুনে দিয়েছিলেন।
তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ঢাকাতেই হবে, অন্য কোনো দেশের রাজধানীতে নয়। তার এই ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ দর্শনই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে অভাবনীয় জয় এনে দিয়েছিল এবং তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।বেগম খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ উপাধিটি কোনো অলংকার নয়, বরং তার কর্মের স্বীকৃতি। ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর যখন অনেক বাঘা বাঘা নেতা সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ নিয়েছিলেন, তখন বেগম জিয়া একচুলও নতিস্বীকার করেননি।
১৯৮৬ সালের ‘পাতানো’ নির্বাচনে অংশ নিতে যখন অনেক রাজনৈতিক দল প্রলুব্ধ হয়েছিল, তখন তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জনগণ ভোট দিতে পারবে না এমন কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তার এই অবিচল অবস্থানের কারণেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধানতম শক্তি। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ফারাক্কা বাঁধের কারণে উত্তরবঙ্গের মরুভ‚মি হওয়ার উপক্রম হওয়া, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যা, কিংবা তিস্তা চুক্তির অনিশ্চয়তা- প্রতিটি ইস্যুতে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ও রাজপথে লড়াই করেছেন।তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বাবার বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে, দাসত্বের ভিত্তিতে নয়’।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৭ সালের ১/১১-এর সময়। তৎকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নে মরিয়া, তখন তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল—যদি তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান, তবে তার ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দেওয়া হবে না। কিন্তু সেই সময় তিনি যে কথাটি বলেছিলেন, তা আজও ইতিহাসের অংশ “দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কিছু নেই, কোনো ঠিকানাও নেই।” কারাগারে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়েছেন, ছেলেদের ওপর নির্মম নির্যাতন দেখেছেন, কিন্তু নিজের আদর্শ ও মাটিকে ছেড়ে পালাননি। ১/১১-এর সেই দুঃসময়ে তার এই একগুঁয়ে দেশপ্রেমই মূলত বাংলাদেশের বিরাজনীতিকরণের নীলনকশাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে জরাজীর্ণ কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। বছরের পর বছর নির্জন কারাবাস, সুচিকিৎসার অভাব এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও তার কণ্ঠস্বর ছিল গণতন্ত্রের সপক্ষে অবিচল।দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি রাজনৈতিক জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মঙ্গলবার ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ তিনি চিরবিদায় নিলেন।