রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে দীর্ঘ ৩৭ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৬টায় মৃত্যুবরণ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মৃত্যুর খবর শোনার পরপরই হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে ভিড় করতে থাকেন। ছুটে যান বিএনপি’র বিভিন্ন সারির নেতারা। অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন। অনেকে হাসপাতালে সামনের সড়কে গড়াগড়ি করে বিলাপ করেন। অনেকে আবার পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন। অনেকে হাত তুলে মোনাজাত করেন।
সরজমিন হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দেখা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরের পরই হাসপাতাল এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এসএসএফের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কনকনে শীত উপেক্ষা করেই আসতে থাকেন শোকার্ত মানুুষ। নেত্রীকে দেখতে না পেলেও শোকার্ত নেতাকর্মী, সমর্থকরা হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান করেন। এ সময় তারা প্রিয় নেত্রীর জন্য দোয়ার আর্জি জানান। কান্না, দোয়া ও মোনাজাতে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেকেই আবেগ ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এভারকেয়ারের সামনে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজপথে ছিলেন। তিনি কোনোদিন অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। কখনো আপস করেননি। তিনি যুদ্ধ করেছেন। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার যখন নির্যাতন, মিথ্যা মামলা করেছে তখন অনেকে তাকে বলেছিলেন কেন এই কষ্ট সহ্য করছেন? তখন তিনি বলেছিলেন, আমি সংগ্রাম করছি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন মনে রাখবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ আজ শোকাহত। তিনি কঠিন সময়ে বিএনপি’র দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এরশাদের স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় তার অবদান বাংলাদেশের মানুষ স্মরণে রাখবে। এ ছাড়াও সেখানে শোক প্রকাশ করতে আসেন সদ্য বিএনপিতে যোগ দেয়া রাশেদ আহমেদ খান, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আমজনতা দলের চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রমুখ।
মৃত্যুর সংবাদ শুনে ধোলাইপাড় থেকে ছুটে আসেন রাবেয়া আক্তার। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, দেশকে বিপদে ফেলে আমাদের মা চলে গেছেন। তিনি দেশের বাইরে যেতে চাননি। বলেছেন- মরতে হলে নিজের দেশেই মরবো। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে শেখ হাসিনা তাকে কারাগারে নিয়েছে। আজকে ঐ স্বৈরাচার কোথায়? আজকে সবার ভালোবাসা নিয়ে খালেদা জিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, অথচ স্বৈরাচার পালিয়ে আছে।
ধানমণ্ডি থেকে আসা মো. আকিব বলেন, রাতে যখন শুনেছি তার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তখনই ভেবেছিলাম হয়তো খারাপ কোনো সংবাদ শুনবো। উনার আপসহীন নেতৃত্ব অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি চাইলে নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনো আপস করেননি। অন্যায়ের কাছে তিনি কখনো মাথানত করেননি।
সাকিল হোসেন বলেন, উনার জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। খালেদা জিয়া আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। ছেলে হারিয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। মিথ্যা মামলায় বিগত সরকার তাকে নির্যাতন করেছে। কিন্তু তারপরেও তিনি মাথানত করেননি। এমন নেতৃত্ব বাংলাদেশে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তিতুমীর কলেজের সাবেক ছাত্রদল নেতা মো. শিমুল বলেন, তিনি সাচ্চা দেশপ্রেমিক ছিলেন। ইতিহাস হয়ে থাকবেন। খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি’র নয়, গোটা দেশের। দলমতনির্বিশেষে সকলে উনাকে ভালোবাসেন। আমাকে যখন পুলিশ মারধর করেছিল উনি নিজে খোঁজ নিয়ে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জ থেকে আসা বিএনপি সমর্থক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, খালেদা জিয়া আমাদের আপসহীন নেত্রী, গণতন্ত্রের মা। রাজনীতির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন।
রাজধানীর মালিবাগ থেকে আসা বিএনপি নেতা নিহাজ্জামান বলেন, আমরা নেত্রীর জন্য দোয়া করি এবং গোটা দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। তিনি কারাবরণ করেছেন কিন্তু দেশের প্রশ্নে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস করেননি। আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন। বৃদ্ধ বয়সে কারাবরণ করে একাকী জীবন কাটিয়েছেন। তিনি কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
টঙ্গী থেকে স্ত্রীসহ এসেছেন আরমান রহমান। তিনি বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই মৃত্যুর খবরটা শুনেছি। দেশ যখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এই সময়ে তার চলে যাওয়াটা দেশের ক্ষতি। তিনি শুধু বিএনপি’র না পুরো বাংলাদেশের অভিভাবক। তার স্ত্রী বলেন, সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে তার। স্বৈরাচার হাসিনার কারণে অনেক কষ্টে দিন পার করেছেন দেশনেত্রী। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, হাসিনা আজ দেশ ছেড়ে পলাতক। আর খালেদা জিয়ার জন্য শোক জানাচ্ছে গোটা দেশ।