আজ সোমবার সকালে মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীকে লক্ষ্য করে 'বোমা হামলা হয়েছে' বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি থেকে দাবি করা হয়, জসিম উদ্দিন রাহমানী অল্পের জন্য ’বোমা হামলা’ থেকে রক্ষা পেয়েছেন এবং তিনি অবরুদ্ধ হয়ে আছেন।
ইনসাফ টোয়েন্টিফোর নামের একটি অনলাইন পোর্টাল ’বোমা হামলা হয়েছে’ দাবি করে খবর প্রকাশ করলে প্রচারণাটি আরও বৃদ্ধি পায়। দ্য বেঙ্গল নিউজ নামের উগ্রবাদ সমর্থক একটি পেইজ থেকেও রাহমানীর উপর ’বোমা হামলা হয়েছে’ বলে প্রচার করা হয়। এছাড়া ফেস দ্য পিপল নামক নিউজ পোর্টালেও রহমানিকে লক্ষ্য করে ‘বোমা নিক্ষেপ’ করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করা হয়। কয়েকটি আইডি থেকে এমনও দাবি করা হয় যে, ’বোমা হামলায় একজন আহত হয়েছেন’।
তবে দ্য ডিসেন্ট সরেজমিনে অনুসন্ধান করে রাহমানীকে লক্ষ্য করে ’বোমা হামলা’র কোন প্রমাণ পায়নি। বরং প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এটি ছিল ’খেলাচ্ছলে’ শিশুদের পটকা ফুটানোর ঘটনা।
সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ধানমন্ডী রিভার ভিউ মডেল টাউনের ভিতর বারৈখালী ১৩ নম্বর রোডে রাহমানীর নির্মিতব্য বাড়ির সামনে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাটি ঘটে।
পটকা ফোটার পর হাজারীবাগ থানা পুলিশ, ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট পটকার অবশিষ্ট অংশ উদ্ধার করেছে।
দ্য ডিসেন্ট ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে এবং প্রত্যক্ষদর্শী ৩ জন ও বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সাথে কথা বলেছে।
পটকাটি ফুটানোর সময় আশেপাশেই ছিল মোহাম্মদ অনিক নামে ১০-১১ বছরের একজন শিশু। শিশু অনিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দ্য ডিসেন্টকে বলেন,“আমি ওই দোকানে (রাহমানীর নির্মিতব্য বাড়ির সামনের দোকান) বইয়া রইছি, আর ও একটা স্পাইডার বোম আনছে, ওই যে চকলেট বোমের মত। আইয়া কইতাছে একটা ম্যাচ দিতে। পরে ওই দোকান থেকে একটা ম্যাচ নিছে। পরে দেখলাম ও বোম ফাটাইতেসে। প্রথমে একবার ফালাইসে, ফাটেনাইগা। পরে ও আবার জ্বালাইলো, জ্বালাইয়া ওইদিকে ফিক্কা মারলো। পরে অনেক জোরে আওয়াজ হইলো। ও রাস্তাতেই ফিক্কা মারছে।”
’পটকা’কে স্থানীয় শিশুরা ‘স্পাইডার বোম’ বা ‘চকলেট বোম’ বলে ডাকে।
অনিক জানায়, যে শিশুটি পটকাটি ফুটিয়েছে তাকে সে চিনে। তার নাম কালু। পটকা ফুটানোর পর কালু সেখান থেকে পালায়নি বলেও জানায় অনিক। অনিক বলে, “অয় পলায় যায় নাই। এই দোকানেই বইয়া ছিল। কারো গায়ে মারেনাই। খেলতেই ফুটাইছে।”
অনিক জানায়, পটকাটি ফুটানোর সময় তার পাশে নীল জামা পরা একজন বয়স্ক লোক ছিল। অনিক যখন আজ সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে দ্য ডিসেন্ট এর প্রতিবেদকের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল তখন জসিম উদ্দিন রাহমানী পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। অনিক পটকাটি ফুটানোর যে বর্ণনা দেয় পাশে দাঁড়ানো রহমানী সেটি সত্য বলে মন্তব্য করেন। রাহমানী তখন জানান, নীল জামা পরা ব্যক্তিটি তিনিই ছিলেন। এসময় বেশ কয়েকজন এলাকাবাসী ও পুলিশ সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজের দৃশ্য শিশু অনিকের বর্ণনার সাথে মিলে যায়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, বেলা ১১টা ৩৪ মিনিটে একটি নীল শীতের জামা পরা এবং লাঠি হাতে রহমানী তার নির্মিতব্য বাড়ির সামনে হাঁটছেন। ১১টা ৩৪ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে রাহমানীর কাছ থেকে বেশ কয়েক ফুট দূরে বালির ছোট একটি স্তুপের উপর পটকাটি রাখছে এক কিশোর; যার নাম কালু বলে শিশু অনিক অনিক জানিয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পর পটকাটি ফুটলে রাহমানীকে কেঁপে উঠতে দেখা যায়। পটকাটি ফুটানোর পর ওই শিশুকে ধীর স্থিরে হেঁটে দোকানের দিকে যেতে দেখা যায়। পটকা যখন ফুটে তখন রহমানীর পাশে রাস্তায় যাতায়াতকারী আরও কয়েকজন নারী পুরুষ ও শিশুকে ফুটেজে দেখা যায়।
পটকাটি বিস্ফোরণের সময় রাহমানীর সাথে ছিলেন ভবনটির নির্মাণকর্মী মাহবুবুর রহমান। আশেপাশেই ছিলেন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা মো. ইউনূস। তারা দু’জনে পটকা বিস্ফোরণের যে বর্ণনা দ্য ডিসেন্টকে দিয়েছেন শিশু অনিকের বর্ণনার সাথে তার মিল রয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজে রাহমানীর অবস্থান ও পটকা ফুটানোর যে স্থান দেখা যায় শিশু অনিক, নির্মাণ কর্মী মাহবুব ও ইউনূসও সে স্থানটিই দেখিয়েছেন দ্য ডিসেন্টকে। ওই স্থান থেকেই পটকার অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাহমানীর বর্ণিত অবস্থান ও পটকা ফুটানোর স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব অন্তত ২০ ফুট।
সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে তিনি এটিকে বোমা হামলা বলার সুযোগ নেই বলে জানান দ্য ডিসেন্টকে।
তিনি বলেন , “এখানে আমাদের থানার টিম এসেছে, সিটিটিসি এসেছে, বোম্ব ডিসপোজাল টিম এসেছে। আমারা যা পেয়েছি এখানে পটকা ফুটানো হয়েছে। কারো উপর হামলার ঘটনাও ঘটেনি। এটাকে আমরা ককটেলও বলতে পারবো না, বোম্বও বলতে পারবো না। কারণ ককটেলে স্প্লিন্টার থাকে। বোম্ব ডিসপোজাল টিম পটকার অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করেছে। আরও অনুসন্ধানের পর জানতে পারবো এখানে আরও কিছু আছে কিনা।”
এদিকে শিশু কালু যে দোকান থেকে পটকাটি কিনেছিল সে দোকানটিকে শনাক্ত করতে পেরেছে দ্য ডিসেন্ট। শরীফ স্টোর নামের বিকাশ-নগদের এজেন্ট ও ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র বিক্রি করা একটি দোকান থেকে ২০ টাকা দিয়ে ২ দিন আগে কালু পটকাটি কিনেছিল বলে দ্য ডিসেন্টকে জানিয়েছে দোকান মালিক মোহাম্মদ নাঈম। শিশু কালু যে ধরণের পটকা কিনেছিল সেগুলোর ছবিও পেয়েছে দ্য ডিসেন্ট। পুলিশ শরীফ স্টোরের সবগুলো পটকা জব্দ করেছে বলে জানিয়েছেন দোকান মালিক নাঈম।
তিনি বলেন, “পটকা তো সবাই বিক্রি করে। এটা তো এমন আহামরি কিছু না। পুলিশ আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, আমার সবগুলা পটকা নিয়ে গেছে, মামলা দেওয়ার কথাও বলছে। সবাই বিক্রি করে এগুলা, এখন আমি একা বিপদে পড়লাম।”
ঘটনা সম্পর্কে রাহমানীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এই ঘটনার পেছনে চাঁদাবাজরা থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ আমলে তার মাদ্রাসার জায়গা দখল করে রাখা হয়েছিল। বাড়ি করার সময় চাঁদা চাওয়া হয়েছিল। তারাই এখন এটি ঘটিয়ে থাকতে পারে।
সুইডেন আসলামসহ শীর্ষ চাঁদাবাজদের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর চাঁদাবাজরা উৎপাত বন্ধ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে একটা চাঁদাবাজ গ্রুপ আছে। এখানে যখন এই ভবনটা শুরু করি। তখন এখানে কিছু চাঁদাবাজ আসছিল। যেহেতু আমি আগে জেলখানায় ছিলাম, ওখানে এই চাঁদাবাজদের যারা বড় নেতা- ইমন, কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, আরমান এরা মূলত ছিল আমার পাশের বিল্ডিংয়ে। এদের সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল। এরা আমাকে খুব সম্মান করতো, খাবার দাবার পাঠাতো, বিভিন্ন মাসলা-মাসায়ের জিজ্ঞেস করতো। সেই সুবাদে আমাকে শ্রদ্ধা করতো। আমি যখন ওদেরকে বিষয়টা জানাইলাম, তখন হয়তো ওরা ওখান থেকে কিছু একটা বলে দিছে, সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এরপরে মাঝখানে কিছু লোক সাইকেল রাখসে। আমার ভাতিজা সাইকেল সরাইতে বলছে। ওরা তখন চরম গালি দিছে। তখন আমার ভাতিজা এসে থাপ্পড় মারছে। ওরা পুরা গ্রুপ নিয়ে আসছে হামলা করবে। এরা বড় একটা সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ গ্রুপ আছে। এই গ্রুপটাই কারসাজিগুলা করতেছে এখানে।”
তবে ওসমান হাদি হত্যার বিচার দাবি করাতেও এ ঘটনাটি করানো হতে পারে বলে দাবি করেছেন রহমানী। তিনি বলেন, “আমি যেহেতু জুমা পড়াইছি শাহবাগে, হাদির হত্যার বিচার দাবি করেছি। এখানে কিছু বাড়ি আছে যেখানে সন্ত্রাসীরা থাকে। এই লোকগুলারে দিয়ে এরা নতুন করে এই কাজগুলা করাইতেছে।”