Image description
নুরুল হুদার স্বীকারোক্তি

রাতের ভোট নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার জবানিতেই উঠে এসেছে নানা চমকপ্রদ তথ্য। ২০১৮ সালে হওয়া এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতা দখল করে। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচনটি আখ্যা পায় রাতের ভোট হিসেবে। পুলিশ এবং প্রশাসনের মাধ্যমে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরা হয় কেন্দ্রে কেন্দ্রে। রাতের এই ভোট নিয়ে তৎকালীন সিইসি নুরুল হুদা সম্প্রতি একটি মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে উঠে এসেছে তার স্বীকারোক্তি ও কীভাবে বাস্তবায়ন হয়েছিল রাতের ভোটের পরিকল্পনা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রাতের ভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। অনিয়ম ও রাতের ভোটের তথ্য লুকাতে দায়িত্বে থাকা মাঠের কর্মীদের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা করেই এই আয়োজন করেছিল। সেই সময়ের গোয়েন্দা সংস্থা পুরো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে এমন তথ্যও জানিয়েছেন সাবেক এই সিইসি।  

রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় দায়ের করা মামলায় দেয়া নুরুল হুদার জবানবন্দির একটি কপি মানবজমিনের কাছে এসেছে।

ওই জবানবন্দি অনুযায়ী ২০১৮ সালের নির্বাচনে রেজাল্ট শিট দেখে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা জানতে পারেন অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে। অনেক কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয় রাতেই। কারাগারে থাকা ৭৭ বছর বয়সী এই নির্বাচন কমিশনার মনে করেন এ ঘটনার জন্য তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগই সম্পূর্ণরূপে দায়ী। 

এতে কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ভোটের দিন সকালে ভোটগ্রহণের ৩০ মিনিট আগে প্রত্যেক কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালট বাক্স খুলে প্রার্থীর পোলিং এজেন্টের উপস্থিতিতে দেখায়। ব্যালট বাক্স শূন্য থাকলে একটি নির্ধারিত ফরম পূরণ করে তাতে প্রিজাইডিং অফিসারসহ পোলিং এজেন্টরা স্বাক্ষর করেন। এরপর প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালট বাক্স সিলগালা করেন। ভোটগ্রহণ শেষে প্রিজাইডিং অফিসারের নেতৃত্বে ব্যালট বাক্স খুলে ভোট গণনা করা হয়। গণনার ফলাফল একটি নির্দিষ্ট ফরমে লিপিবদ্ধ করেন। প্রিজাইডিং অফিসার ওই ফরমে মিডিয়া/পর্যবেক্ষক ও পোলিং এজেন্টদের সামনে স্বাক্ষর করেন। নির্বাচনী মালামাল রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ফলাফলসহ কেন্দ্র থেকে জমা করেন। নির্বাচন কমিশনারের রিটার্নিং অফিসাররা ফলাফলের এক কপি নির্বাচন কার্যালয়ে জমা দেন।’

২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমি রেজাল্ট শিট দেখে জানতে পারি, অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়ে- যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আরও শুনেছি, অনেক কেন্দ্রেই রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার ভর্তি করা হয়। রাতেই ভোট দেয়া হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রভাবে তাদের কর্মী বাহিনী, দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের সহযোগিতায় এই কাণ্ড ঘটেছে বলে আমি মনে করি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এই ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি বা আমার কমিশনের সদস্যদের অন্ধকারে রেখে এই অরাজক পরিস্থিতি এবং ভোটে অনিয়ম করা হয়। এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট বিব্রত ছিলাম। তবে যেহেতু গেজেট প্রকাশের পর আমাদের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা থাকে না; তাই আমি নির্বাচন বাতিল করতে পারিনি। তবে আমি সংবাদ মাধ্যমে একাধিকবার জানিয়েছি এবং এই ধরনের নির্বাচনের বিষয়ে আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছি। নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু এসব কর্মকর্তারা তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনকে অন্ধকারে রেখে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে বলে আমি মনে করি।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা প্রসঙ্গে জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও আমাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করেনি। তারা আমাকে প্রকৃত ঘটনা জানায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা ব্যালট বাক্সে আগের দিন রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি করে দেয় বলে আমি শুনেছি। নির্বাচনের পূর্বে পুলিশ গণহারে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছিল বলে আমি অভিযোগ পাই। এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা জানায়, ওই সকল লোকদের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে, সে কারণে আমি কিছু করতে পারিনি। আমি মনে করি ওইসব মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পুলিশের তৈরি করা।’

ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন কে এম নুরুল হুদার ভাগনে। এ বিষয়ে জবানবন্দিতে কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে আমার ভাগনে পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে এমপি প্রার্থী হয়। সে ক্ষমতাসীন দলের প্রতীকে নির্বাচন করেছে। নির্বাচনে তার মনোনয়ন পেতে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পূর্ব থেকেই সে স্থানীয়ভাবে রাজনীতি করতো। তবে তার কোনো পদ-পদবি ছিল না। তবে আমার ভাগনে হিসেবে সে কিছু প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে-  এ বিষয়ে আমার কাছে সরাসরি অভিযোগ না আসার কারণ দু’টি হতে পারে। প্রথমত, আমার অজ্ঞাতে টাকা দিয়ে নির্বাচনী ফিল্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখ বন্ধ করা হতে পারে। তাছাড়া আনসার ও স্কুল শিক্ষকসহ কর্মচারীরা রাজনৈতিক দলের প্রভাবে চাকরিতে ক্ষতি হওয়ার ভয়ে চেপে যায়। তবে যারা ক্ষমতায় ছিল এবং পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সেসব বেনিফিসিয়ারিদের সেন্ট্রালি অর্গানাইজড করে টাকা বিতরণ ও দিনের ভোট রাতে করেছে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ তারা তখন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় ছিল। আমি মনে করি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করে প্রশাসন ও পুলিশের কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও কারচুপি করে দিনের ভোট রাতে গ্রহণ করেছে। অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় শতভাগ ভোটগ্রহণ দেখানো হয়েছে। যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তৎকালীন সরকারি দলের সরাসরি হস্তক্ষেপেই অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়েছে। কিছু অতিউৎসাহী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্বাচনী অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে বলে আমি মনে করি।’

তৎকালীন ইসি সচিবের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন হেলাল উদ্দিন আহম্মেদ। আমার কাছে নির্বাচনে তার ভূমিকা সন্দেহজনক মনে হয়েছে। কারণ যেহেতু তিনি প্রশাসন ক্যাডারের লোক। তার পক্ষে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব ছিল।’ 

নির্বাচনে অনিয়ম এবং রাতে ভোট করার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো কেন সংবাদ প্রকাশ করেনি সে বিষয়েও কে এম নুরুল হুদা তার মত তুলে ধরেন জবানবন্দিতে। তিনি বলেন, ‘আমি আরও মনে করি- সংবাদমাধ্যমকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার অর্থের বিনিময়ে তাদের পক্ষে নিয়ে নেয়। কারণ সংবাদমাধ্যমগুলো নির্বাচনে সংঘটিত সার্বিক অনিয়ম ও রাতে ভোট করার বিষয়ে কোনো প্রকার সংবাদ প্রকাশ করেনি। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআই’র কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরে নির্বাচন ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করেছিল বলে আমি পরে বুঝতে পারি।’