সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন, তাদের বিচার করতে কোনো আইনি বাধা নেই—রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন মন্তব্য করেছেন বিচারক।
আজ সোমবার (১ ডিসেম্বর) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক মো. রবিউল আলম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রধান আসামি শেখ রেহানার ৭ বছর, দ্বিতীয় আসামি টিউলিপ সিদ্দিকের ২ বছর এবং তৃতীয় আসামি শেখ হাসিনার ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, আবাসন সুবিধা থাকার পরও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বোন শেখ রেহানা ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক প্রভাবিত করেন। এরপর ভুয়া হলফনামা দিয়ে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নেন।
বিদেশে অবস্থান করলেও তাদের বিচার হতে পারে—এই প্রসঙ্গে বিচারক বলেন, ‘শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক পৃথিবীর যেখানে থাকুন না কেন, তাদের বিচার করতে কোনো বাধা নেই।’
আদালত আরও বলেন, ‘আসামিদের আদালতে হাজির করতে বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় ও গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছে। তাই বলা যাবে না যে, তারা আদালতে উপস্থিত হতে পারেননি বা বাধা দেওয়া হয়েছে।’
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে মিথ্যা হলফনামা, তথ্য গোপন ও বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে বিধিবিধান না মেনে নিজের পরিবারকে প্লট বরাদ্দে সহায়তা করেন।
আদালত বলেন, টিউলিপ সিদ্দিক বিদেশ থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপ ব্যবহার করে মামলার অন্যান্য আসামিদেরও প্রভাবিত করেছেন। কর্মকর্তারাও বিধি অমান্য করে ফাইল প্রস্তুত করে প্লট বরাদ্দ দেন। আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, ‘মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন—দুর্নীতিতে কাউকে সহযোগিতা করো না। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে সাহায্য করেছেন।’
৫ বছর করে সাজাপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামিরা হলেন—জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, অতিরিক্ত সচিব অলিউল্লাহ, সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের পিএ মো. আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, তন্ময় দাস, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, সাবেক পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম, উপপরিচালক নায়েব আলী শরীফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। তাদের মধ্যে খুরশীদ আলম কারাগারে রয়েছেন, বাকিরা পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
গত ৩১ জুলাই এই মামলার অভিযোগ গঠন হয়। বিচার চলাকালে ৩২ জন সাক্ষ্য দেন। অভিযোগে বলা হয়, ক্ষমতায় থাকার সময় শেখ হাসিনা ও তার পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। গরিব দেখিয়ে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর সড়কের ৬টি প্লট নিজেদের নামে বরাদ্দ নেন, অথচ তারা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য ছিলেন না।
চার্জশিটে টিউলিপের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে দুদক জানায়, প্লট নিজের নামে বরাদ্দ না থাকলেও, টিউলিপ জানতে পারেন তার খালা শেখ হাসিনা তার নিজের, ছেলে জয় এবং মেয়ে পুতুলের নামে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নিচ্ছেন। তখন যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি তার মা শেখ রেহানা, ভাই রাদওয়ান মুজিব ও বোন আজমিনার নামে প্লট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে তার ‘বিশেষ ক্ষমতা’ ব্যবহার করে শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।
চার্জশিটে আরও বলা হয়, শেখ রেহানাও তার বোন শেখ হাসিনার কাছে প্লট চেয়ে আবদার করেন।
গত জানুয়ারিতে এই দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক ছয়টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এখন পর্যন্ত চারটির রায় ঘোষণা হয়েছে। এর আগে গত ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা তিন মামলায় তাকে ৭ বছর করে ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ৫ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।