আব্দুল আউয়াল মিন্টু। এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এবং রাজনীতিবিদ। বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান মিন্টু মাল্টিমোড গ্রুপের প্রধান নির্বাহী। ‘লাল তীর সীডস লিমিটেড’-এরও চেয়ারম্যান তিনি। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-৩ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়বেন। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও রাজনীতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে চান। জামায়াতের প্রার্থীর সঙ্গে একত্রে নিজ নিজ প্রতীকের পক্ষে প্রচার চালাতেও আপত্তি নেই তার। সম্প্রতি কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা, নিজ এলাকাসহ জেলার উন্নয়ন পরিকল্পনা, মূল্যস্ফীতি, পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ, ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কারসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার রাজকুমার নন্দী
ফেনী-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে দল আপনাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আপনার অনুভূতি কেমন?
আব্দুল আউয়াল মিন্টু: এটা নিয়ে আমার তেমন কোনো অনুভূতি নেই। এ জন্য যে আমি নিজে তো জীবনে কোনোদিন নির্বাচন করিনি। অবশ্য ভাইদের জন্য পৌরসভা নির্বাচন করেছি, উপজেলা নির্বাচন করেছি, ছেলের জন্য মেয়র নির্বাচন করেছি। আমি নিজে কোনোদিন নির্বাচন করিনি। আমার এমন কোনো ইচ্ছাও ছিল না যে, আমি নির্বাচন করব। এখন দল থেকে আমার নাম দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে তো আমার অনুভূতি ইতিবাচক। দল বলেছে নির্বাচন করার জন্য—এটাকেও আমি একটা দায়িত্ব এবং কর্তব্য হিসেবে নিয়েছি। ১৯৯৬ সাল থেকে যখনই ইলেকশন আসে, তখনই আমার এলাকার লোকজন আমাকে চাপ দিয়েছেন; কিন্তু আমি ইলেকশন করিনি। এবার একটা নতুন প্রেক্ষাপট। আমরা একটা বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি, সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আগের সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) পলাতক। এখন এই নতুন প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি—আমারও বয়স বেড়ে গেছে, ঠিক আছে ইলেকশনটা করি। তো ওইদিক থেকে অনুভূতি পজিটিভ। একটু লম্বা উত্তর দিলাম এজন্য যে, অনেকে তো ইলেকশন করার জন্য, নমিনেশন পাওয়ার জন্য সবসময় ঘোরাঘুরি করে; আমি কোনোদিন সেটা করিনি, এবারও করিনি। এটা (মনোনয়ন) আল্লাহর তরফ থেকে হয়েছে, সেজন্য আমি খুশি। এখন বাকিটা জনগণের ওপর, আল্লাহর ওপর নির্ভর করে।
কালবেলা: ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ায় ফেনী-৩ আসনের জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ডা. ফখরুদ্দিন মানিক আপনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মিন্টু: যে কোনো নির্বাচনে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হয়, তাহলে তো আর সেটা নির্বাচন হয় না। আমি সবসময় মনে করি, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেটা নির্বাচনে হোক বা এমন যে কোনো ইস্যুতে হোক—দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি। আমি ডা. ফখরুদ্দিন মানিক সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে, উনি আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। তাও আমাকে না পেয়ে কল করেছেন আমার ছেলেকে; পরে ছেলের থেকে আমি উনার নম্বর নিয়ে আবার উনাকে কল করেছি। উনি খুব ভদ্রলোক মানুষ। পরবর্তীতে আমরা দুজন শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। পূজার সময় উনি আমার সঙ্গে ছিলেন। আমার তরফে কোনো আপত্তি নেই, যদি আমরা দুজন একসঙ্গে ক্যাম্পেইন করি। আমি মনে করি, নির্বাচনে যাই হোক— আমাদের কোনোরকম কোনো সমস্যা হবে না। সবাই তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। নির্বাচনে ডা. মানিকও হয়তো কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি করবেন না, আর আমি তো করবই না। আমার তো উত্তেজনা সৃষ্টি করার কোনো দরকারই নেই। ভোট তো দিবে জনগণ, আমি শুধু যেটা চাই, সেটা হলো—জনগণ যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। জনগণ যদি ধানের শীষে ভোট দেয়, সেটা আমার জন্য ভালো; জনগণ যদি দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেয়, এখানে আমার কিছু বলার নেই। জনগণ যাকে পছন্দ করবে, তাকেই ভোট দিয়ে তারা তাদের নেতা নির্বাচিত করবে।
কালবেলা: নির্বাচন নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
মিন্টু: নির্বাচনে আর বিশেষ পরিকল্পনা কী। এখন তো নতুন একটা প্রযুক্তির যুগ। সবাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম অর্থাৎ ফেসবুক, ইউটিউব এগুলোতে প্রচারণা চালায়, আমরাও সেটা করব। আর মেইন হলো জনগণের কাছে যাওয়া, জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়া, যতটুকু সম্ভব আমি সেটাই করব।
কালবেলা: নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?
মিন্টু: শোনেন, সব মানুষই ভালো আশা করে। আমি মনে করি, শাসন-কর্তৃত্ব, এমপি-মন্ত্রী এগুলো আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। আমাকে তো এরশাদ সাহেব ১৯৮৬ সালে ইলেকশন করতে বলেছিলেন; ১৯৯০ এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগও বলেছিল ইলেকশন করেন। এটা সবাই জানে, এটা তো আর লুকানোর কিছু নেই যে, আমি একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমাকে ২০০১ সালে ম্যাডামও (খালেদা জিয়া) ইলেকশন করার জন্য বলেছিলেন; কিন্তু আমি ইলেকশন করিনি। এরপর ২০০৮ সালেও ম্যাডাম বলেছিলেন; কিন্তু আমি ইলেকশন করিনি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালেও বিএনপি থেকে আমাকে ইলেকশন করতে বলা হয়েছিল, আমি করিনি। আল্লাহর হুকুমে এবার মনোনয়ন দিয়েছেন।
কালবেলা: বিজয়ী হলে আপনার নির্বাচনী এলাকাসহ পুরো ফেনী জেলার উন্নয়নে কী করতে চান?
মিন্টু: আমি দেখলাম যে, আমাদের লোকজনের দাবি হচ্ছে একটা মেডিকেল কলেজ, একটা পাবলিক ইউনিভার্সিটি, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন—এগুলো। এ ছাড়া এমপিদের আর কী করার আছে। এমপিদের একচুয়ালি মেইন কাজ হওয়া উচিত সংসদে আইন পাস করা। আর অন্যান্য দেশের উদাহরণ যদি আপনি দেখেন, ওই পার্টিকুলার জায়গার যে উন্নয়ন—সেটা নির্ভর করে স্থানীয় সরকারের ওপর। যেগুলো ওদের হাতে নেই, যেমন পাবলিক ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ—এসব ক্ষেত্রে আমরা দেখব যে, ফেনী জেলার যেন উন্নয়ন হয়। বলতে গেলে ২০০৬ সাল থেকেই ফেনী জেলা একচুয়ালি এক ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ওখানে উন্নয়ন তেমন কিছু হয়নি, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি, অন্য সেক্টরে উন্নয়ন হয়নি। ম্যাডাম ফেনী-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন, উনি তো জয়লাভ করবেনই। আশা করি, ফেনী-২ আসনেও আমরা জয়লাভ করব। ফেনী-৩ আসনে আমিও আশাবাদী। আমরা যদি জয়লাভ করি এবং আমাদের দল যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে জনগণের যে চাহিদাগুলোর কথা আমরা শুনব, সেগুলো পূরণ করার জন্য আমরা সচেষ্ট থাকব।
কালবেলা: বিএনপি এরই মধ্যে ২৩৭ আসনে দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। প্রার্থীরা কেমন হলো?
মিন্টু: দেখেন—দল তো বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়াতে চিন্তা করে মনোনয়ন দিয়েছে। কারো টাকা-পয়সা আছে, সেটা শুধু নয়; দল দেখেছে কে কর্মীবান্ধব, কে এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশি; দল দেখেছে তার পুরোনো দিনের ব্যাকগ্রাউন্ড অর্থাৎ ভালোমন্দ দিক যেটা আছে—এগুলো সব বিচার-বিবেচনায় এনে দল মনোনয়ন দিয়েছে। অতএব, দল যাকে মনোনয়ন নিয়েছে, আমি মনে করি, সেই প্রার্থী ভালো। এখানে আর অন্য কিছু চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই।
২৩৭টি সিটের মধ্যে হয়তো ৫-১০টি সিটে মনোনয়ন নিয়ে আমাদের একটু দ্বিমত আছে; তবে সেটা কিন্তু পার্টির চিন্তাধারার সঙ্গে কোনো বিরোধ না। এটা হলো স্থানীয়ভাবে অনেকে মনে করেন যে, যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন, তার থেকে তিনি বেশি যোগ্য। সেটা (মনোনয়ন) তো বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়াতে চিন্তা করা হয়েছে। অতএব, আমি মনে করি, যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তারা সবাই যোগ্য। আবার যারা মনোনয়ন পাননি, তারাও যে যোগ্য না—সেটাও বলা যাবে না। এখন কথা হলো—যোগ্যতার মাপকাঠি তো সবসময় এক থাকে না। অনেক ক্রাইটেরিয়া বা অনেক সূচক ধরে চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিশ্লেষণ করে সব কিছু দেখে তারপর দল মনোনয়ন দিয়েছে। অতএব, আমার মনে হয় না, এটা নিয়ে পার্টির ভেতরে বা বাইরে খুব একটা বেশি কোনো বিরোধ হবে।
কালবেলা: বাংলাদেশে এখন যে ইনফ্লেশন (মূল্যস্ফীতি) রেটটা আছে—জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাজারের দিকে নজর দেওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না কিংবা ইচ্ছা করে দেয়নি। সামনে যে ইলেকশন মৌসুমটা আসছে, নরমালি ইলেকশনে মানিটা বেড়ে যায়। এই যে ইনফ্লেশনের এখন যে হার, এটার সঙ্গে সাধারণ জনগণ আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তারা কীভাবে ম্যাচ করবে?
মিন্টু: প্রথম কথা হলো আমাদের এই ইনফ্লেশন এখন এভারেজ ৮ শতাংশ। গত দুই-তিন বছর থেকে প্রায় ৯ শতাংশ, তার থেকে একটু কমতে কমতে ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে বা গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যানকে আমি বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না। বিভিন্ন কারণে এখন ইনফ্লেশনটা দুরকম। একটি হলো খাদ্য, আরেকটি হলো খাদ্যবহির্ভূত। সাধারণ নিয়মে যখন খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখন গরিব লোকেরা বেশি ভুক্তভোগী হয়। কারণ, একজন সাধারণ লোক দিন আনে দিন খায়, সে একজন রিকশাচালক ভাই বা একজন দিনমজুর, তাদের শতকরা ৭০ শতাংশ পয়সা চলে যায় শুধু খাদ্য কিনতে। যখনই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখনই তারা বেশি ভুক্তভোগী। এখন সরকার চাইলেই কি মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে, আমার মনে হয় না। মূল্যস্ফীতির বিভিন্ন কারণ আছে। একটি হলো যদি মানুষের ডিমান্ডটা বেড়ে যায়। মানুষের কাছে টাকা বেশি, সেজন্য মানুষ কিনবে বেশি। বাজারে খাদ্যপণ্য মানে যদি সাপ্লাইয়ের তুলনায় চাহিদা বেশি হয়, দাম বেড়ে যাবে। আরেকটি হলো খাদ্যপণ্য নেই অর্থাৎ খাদ্যপণ্য বা যে কোনো পণ্য শর্টেজ আছে বিধায় এটার এখন দাম বেশি। ডিমান্ড বেশি, সাপ্লাই কম—বাংলাদেশে সেটা যদি হয়, তাহলে এখন বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে যে নীতি অনুসরণ করছে সেটা হলো—আমি মানি সাপ্লাই কমাব; কিন্তু আপনাকে আগে দেখতে হবে যে, মানি সাপ্লাইয়ের জন্য ইনফ্লেশন হচ্ছে, না অন্য কোনো কারণে ইনফ্লেশন হচ্ছে। যদি মানি সাপ্লাই কম, ডিমান্ডও কম- তারপরও মূল্য বাড়ছে, তাহলে তো এটা টাকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশে এখন টাকা মানুষের সঙ্গে কীভাবে কাজ করে? একটা তো সাধারণ লোক চাকরি-বাকরি করে; কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছর থেকে মূল্যস্ফীতি মানুষের আয় প্রায় ৩ শতাংশ কম; যেটা সরকার বলছে।
সরকারি ডাটা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ থেকে ১০ শতাংশের ভেতরে; আর মানুষের আয় বাড়ছে মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ—তার মানে মানুষের আয় মূল্যস্ফীতি থেকে কম। সে ক্ষেত্রে তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে কেন? আয় যদি কম হয়, টাকা তো কম থাকার কথা; কিন্তু একটি হিসাব আমাদের বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরি, সেটা হলো—বাংলাদেশে এখন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার আমাদের রেমিট্যান্স আসে। এগুলো কিন্তু সাধারণ গ্রামগঞ্জে, প্রতিটি পরিবারে যাচ্ছে। মানে তাদের হাতে একটা টাকা আসছে—যেটা দিয়ে তারা কেনাকাটা করতে পারে; সেটা খাদ্য হতে পারে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্য হতে পারে। অতএব, সরকার যদি নীতিগতভাবে মানি সাপ্লাই কমায়, তাতে কিন্তু ওই টাকা আসা তো বন্ধ হবে না। ওই টাকাটা তো তাদের হাতে আসবেই। বাংলাদেশে আমি মনে করি, যদি আপনি একরোখা একটি নীতি ফলো করেন, শুধু মানি সাপ্লাই কম করে মানুষের হাতে টাকা যেন কম যায়, তাহলে কিন্তু অন্যদিক দিয়ে ওই মূল্যস্ফীতি আরও সৃষ্টি করবে। ধরুন, এখন টাকা নেই, আমি একটি এলসি খুললাম না। বাংলাদেশের প্রতিটি জিনিসই ইমপোর্টবেইজড। আমরা যদি ইন্ডাস্ট্রিতে যাই, প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রির ৫০ শতাংশ র-ম্যাটেরিয়ালস আমাদের ইমপোর্ট করতে হয়। খাদ্যে আমরা বলি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এটাতো আমার জানা নেই। মাঝে মধ্যে আমাদের চাল আমদানি কম হয়, দুই-তিন বছর পর পর যখন এক বছর খুব ভালো প্রোডাকশন হয়। এ বছরে আমাদের মিনিমাম ৩০ শতাংশ চাল আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশে এখন ৯০ লাখ টন ভুট্টা লাগে। আমরা প্রোডাকশন করছি মাত্র ৬০ লাখ টন, ৩০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। আটা-ময়দা এগুলোর জন্য আমাদের ৯৬ লাখ টন গম লাগে। অথচ আমরা প্রোডাকশন করি মাত্র ৬ থেকে ৭ লাখ টন। মসুর ডাল, ছোলার ডাল—এটা আমাদের ৮০ শতাংশ ইমপোর্ট করতে হয়। এগুলো সরকার বলছে। তাহলে তো সরকার ৯০ শতাংশ ইমপোর্ট করছে।
আমাদের প্রায় ৩০ বা ৪০ শতাংশ দুধ পাউডার হিসেবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তেল ছাড়া তো আমরা রান্না করতে পারি না। তেল তো ৯২ শতাংশ বাইরে থেকে আনতে হয়। এখন যদি আমরা মানি সাপ্লাই খুব কমাই, আর যদি ঠিকমতো ব্যাংক দ্বারা এলসি যথাসময়ে না যায়, তাহলে তো মার্কেটে ওই পণ্যগুলোর সংকট হবে। তখন মার্কেটে সাপ্লাই কমবে; কিন্তু ডিমান্ড তো কমবে না। কিছু কিছু পণ্য আছে, যেগুলো বাজারে যাই দাম হোক—যদি দাম কমায়, তাহলে মানুষ কেনে বেশি। আবার কিছু কিছু পণ্য আছে দাম যদি বেড়েও যায়, ওটা কম কিনতে পারবে না। যেমন তিনজনের একটি পরিবার, তার এক কেজি চাল লাগবে। এখন চালের দাম ১০ টাকা হলেও তাকে এক কেজি কিনতে হবে, ২০ টাকা হলেও এক কেজি কিনতে হবে। এটা ইনলাস্টিক। এখন কথাটা হলো যে, সবকিছুতে যদি আমরা মনে করি—খালি মূল্যস্ফীতি কমে যাবে, যদি আমরা মানি সাপ্লাই কমাই; এটা কিন্তু নেহায়েত ভুল ধারণা, যেটা আমাদের সরকার এখন করছে।
কালবেলা: কাজ করার জন্য যেটা সরকারের পলিসি, এটা কি আসলেই সঠিক?
মিন্টু: এটা প্রাকটিক্যালি সঠিক। কারণ, বিশ্বব্যাপী থিওরিটিক্যালি বলে যে, যদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়, তাহলে টাকার সরবরাহ যদি কমানো হয়, মানুষের কাছে টাকা কম যাবে, মানুষের ডিমান্ড কমে যাবে। অতএব, মানুষ কিনবে কম, ফলে দাম কমে যাবে। এটা হলো থিওরি, তবে সব থিওরি কিন্তু সব সমাজের বেলায় প্রযোজ্য না।
কালবেলা: সেক্ষেত্রে যে ইনভেস্টমেন্ট এটা করতে গিয়ে তো নেট রেজাল্টও পাচ্ছে না, আবার ইনভেস্টমেন্টও কমে যাচ্ছে।
মিন্টু: এখন থেকে ২০ বছর আগে কেউ যদি ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে যেত—১০ ফুট, ২০ ফুট পরে পরে দেখতো যে, এদিকে বিল্ডিং হয়, ওদিকে বিল্ডিং হয়, এদিকে কারখানা হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে সবদিকে কিছু হচ্ছে। এখন ওখানে কিছু দেখে কেউ? আর সম্প্রতি পেপারে দেখলাম যে, গত মাসেই গত কোয়ার্টারে ১৮ শতাংশ কম মূলধনী যন্ত্রপাতি এক্সিকিউট হয়েছে। এখন কথা হলো যে, যদি মূলধনী যন্ত্রপাতি কম হয়, তাহলে ইনভেস্টমেন্টটা কোথায় হইছে? আর ইনভেস্টমেন্ট হলো দুই প্রকার। একটি হলো আমাদের লোকাল, আরেকটি বৈদেশিক। লোকাল ইনভেস্টমেন্ট কোথা থেকে আসে? সেভিংস থেকে আসে। বাংলাদেশে গত চার বছরে সেভিংস কমছে, এটা বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান। যে কোনো দেশে বিনিয়োগের শতকরা ৯৭ শতাংশ আসে নিজস্ব সঞ্চয় থেকে। আমাদের যদি সঞ্চয় কমে যায়, অন্যদিকে যদি আমরা একটি সংকুচিত রাজস্ব নীতি-সংকুচিত মুদ্রা নীতি ফলো করি, তাহলে সংকুচিত রাজস্ব নীতি ফলো করতে হবে—যেমন সরকার খরচ কমাতে চায়। সরকার যদি খরচ কমায়, আর যদি মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমরা সংকুচিত মুদ্রানীতি ফলো করি, তাহলে বিনিয়োগটা কীভাবে হচ্ছে। আর যদি আমাদের ইনফ্লেশন ৯ বা ১০ শতাংশ হয় এবং আমাদের ওয়েজ ইনকাম ৩ শতাংশের কমও হয়, তাহলে সঞ্চয় তো হবে না। সঞ্চয় না হলে বিনিয়োগটা কোথা থেকে আসবে? বিনিয়োগের একমাত্র উপায় হলো নিজস্ব সঞ্চয় থেকে ৯৭ শতাংশ আর তিন থেকে চার শতাংশ আসবে বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে। যদি একটা দিনে সঞ্চয়-আয় কমে যায়, তাহলে অটোমেটিক সঞ্চয় কমে যাবে। আর সঞ্চয় কমে গেলে অটোমেটিকলি বিনিয়োগ কমে যাবে। অতএব, বিডা কী বলল, অমুক উপদেষ্টা কী বলল— এগুলো কোনো ইস্যু নয়। সোজা হিসাব—মূল্যস্ফীতি যদি ইনকাম থেকে বেশি হয়, সেখানে সঞ্চয় কমে যাবে। সঞ্চয় কমে গেলে কোনো বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে রাস্তায় মারামারি, হানাহানি তথা অস্থিরতা চলতে থাকবে। যখনই সামাজিক অস্থিরতা হবে, সেখানে তো এমনিই বিনিয়োগ হবে না।
কালবেলা: আপনি ব্যাংকে দীর্ঘদিন আছেন, এখনো আছেন। পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার যে বিষয় বা আরও অন্য দুর্বল ব্যাংক ছিল, এখানে শেয়ার হোল্ডাররা আপত্তি করেছিল—তাদের দিকটা কী হবে। এখানে যারা দায়ী, তাদের কোনো দায়মুক্তি দেওয়ার বিষয় আছে কি না বা এই পলিসিটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মিন্টু: এটা একটি পলিসি। একীভূত করা আমি খুব কম দেশেই দেখেছি। বন্ধ করে দেওয়া অনেক দেশে দেখেছি। একীভূত করা নিয়ে এর আগেও একবার কথা হচ্ছিল। দুই-একটি একীভূত হইছেও মনে হয়। অ্যাট দ্য অ্যান্ড অব দ্য ডে, এটা তো বাংলাদেশ ব্যাংকই করছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে শেষ পর্যন্ত এটাকে ইমপ্লিমেন্ট করবে? ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য তো তারা অনেকখানি এগিয়েও গেছে। যেমন সব বোর্ড ভেঙে দিয়েছে। সব জায়গায় প্রশাসক নিয়োগ করছে; কিন্তু আমি মনে করি—এসব জিনিস যখন করা হয়, তখন জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার দ্বারা যদি এটা করা না হয়—তাহলে জনগণের যে চাহিদা, জনগণের যে চিন্তাধারা— এগুলো কখনো প্রতিফলিত হয় না। একটি আইসোলেটেড গোষ্ঠী কতগুলো আইসোলেটেড ডিসিশন নিচ্ছে। এগুলো শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়ন হবে বা বাস্তবায়ন হওয়ার পথে কত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, এটা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে আমি মনে করি, এখানে বহু প্রতিবন্ধকতা আসবে।
এখন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেই যদি এটাকে আইন মনে করেন যে, এটাকে আপনি ইমপ্লিমেন্ট করবেন—তাহলে এই যে সংসদ, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দল, তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা আপসরফা, সমঝোতা— এগুলোর তো তাহলে কোনো দরকার ছিল না। এটা ছাড়াও আরও অনেক কাজ আছে। আমি মনে করি, এই কাজগুলো রাজনৈতিক সরকার আসার পরে করাটাই ভালো ছিল। না হলে এগুলো পরে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আমাদের দেশে একটি রীতিনীতি হয়ে গেছে যে, কয়েকজন লোক টাকা দিয়েছে, তারা ব্যাংকের মালিক—আসলে এ কথা সত্য না। ব্যাংকের প্রথম মালিক হলো ব্যাংকের ডিপোজিটর। সেকেন্ড হলো যারা ঋণ নেয় তারা। তিন নম্বরে হলো যারা ব্যাংকে কিছু মূলধন জোগান দেন তারা। এখন তিন নম্বর এসে বলছে যে, আমি মালিক। তিন নম্বরও মালিক না, এক নম্বরও মালিক না, দুই নম্বরও মালিক না। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে আমরা মালিক। এখন এগুলোর ভেতরে অসংলগ্নতা আছে। এগুলো শেষ পর্যন্ত কতটুকু টিকবে এবং যৌক্তিকতা কতটুকু দেখাতে পারবে, এটা আমার কাছে এ মুহূর্তে বিশ্বাসযোগ্য না।
কালবেলা: বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মালিকই মনে করে বা ব্যাংকগুলো তদারক করার জন্য সে দায়িত্ব পাচ্ছে, রেগুলেট করবে; কিন্তু যখন এই ব্যাংকগুলোতে এই অনিয়মগুলো হচ্ছিল, তখন তাদের কনসার্ন ডিপার্টমেন্ট কাজ করেনি কেন বা বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে গেল না কেন—কিংবা অ্যাকশনে যাওয়া উচিত ছিল কি না বা এই ভূমিকাটা কী?
মিন্টু: আমি তো ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের ডাইরেক্টর ছিলাম এবং তখনকার দিনে প্রাইভেট সেক্টরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ছিল সেটা। এখন কিন্তু আমি নতুন করে ডাইরেক্টর হয়েছি। মধ্যখান থেকে ২০০৭-২০২৪ পর্যন্ত আমি কিন্তু ডাইরেক্টর ছিলাম না। যে ধরনের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, নৈতিকতাবিহীন কাজ, দুর্নীতি—এটা আমি কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না, যদি আমি এই ব্যাংকে আবার ডাইরেক্টর না হতাম। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সবকিছুই হয়েছে কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাকের ডগা দিয়ে। এমন কিছু নেই, যেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতো না এবং অনেক কিছু আছে, যেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাপ্রুভালও আছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকের পরিশোধের ওপর। এবার একটি কথা বলি, আমাদের রেগুলেটরি ওভাররিচ কোন পর্যায়ে গেছে যে, বাংলাদেশে একটি ব্যাংকে যখন এমডি নিযুক্ত করা হয়, এটা কিন্তু বোর্ড এমনে নাম পাঠায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টারভিউ নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টারভিউ নেওয়ার পরে উনি কত টাকা বেতন পাবেন, সেটাও ধার্য করে দেয়। আমি নিজে চেয়ারম্যান হওয়ার পরে বারবার বলছি সার্কুলার দাও যে, চেয়ারম্যানের দায়িত্বটা কী। আজ পর্যন্ত আমি কোনো দায়িত্ব খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এমডি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ইন্টারভিউ নিয়ে এবং বেতনও ঠিক করে— তাহলে এখানে পরিষদের দায়িত্বটা কী। পৃথিবীর একটি দেশও নেই যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমডি নিয়োগ করে। এরকম প্রতিটি ধাপে ধাপে এত রেগুলেশনস করা হয়েছে, এখানে তো কিছুই খারাপ হওয়ার কথা না; কিন্তু যত খারাপ বাংলার ব্যাংকিংয়ে হয়েছে, এটা পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি। এটা গভর্নর সাহেব নিজেও বলেছেন। এখন কথাটি হলো যে, অনেক রেগুলেশন করা হয়েছে যেগুলোর কোনো দরকারই নেই। আবার অনেক রেগুলেশন নেই; কিন্তু সংস্কার তো করা হচ্ছে। তাদের সংস্কারের ভেতরে আমি পেপারে দেখি যে, গভর্নর সাহেবের পজিশন মন্ত্রীর সমান হবে। তারপর আরও দু-একটি দিক, যেগুলোর সঙ্গে আর্থিক সেক্টরের উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। এখন তারা নিজে নিজে এগুলো করছেন। একটি সময় আসবে ঘষামাজা তো করা হবে। যখন নির্বাচিত সরকার আসবে, তখন এই যে প্রজ্ঞাপন দিয়ে যেগুলোকে আইন বলা হচ্ছে, এগুলো তো ঘষামাজা করা হবে। নিয়ম হলো যে—প্রজ্ঞাপন দিয়ে আইন বানানো বিষয়গুলো সংসদ বসার পরে যদি ছয় মাসের ভেতরে অ্যাপ্রুভাল না হয়, সংসদে তাহলে এগুলো অটোমেটিকলি বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি এগুলো সংসদে ওঠানো হয়, তাহলে সেগুলো কিন্তু সংসদ সদস্যরা ভালো-মন্দ বিচার করে আইন পাস করবে। একটি উদাহরণ দেওয়া লাগতে পারে যে, ২০০৭-০৮ এ প্রায় ১৮৯টি আইন সংস্কার করা হয়েছিল। যতটুকু আমি জানি, গত সরকারগুলো বলছিল যে, এসব আইন সংসদে পাস করে দিব; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, ১৫ বছরে মাত্র ছয়টি বা সাতটি আইন সংসদে উঠিয়েছে এবং এই আইনগুলো যখন পাস করেছে—এমনভাবে কাটাছেঁড়া করেছে যে, এটা আগের আইন থেকেও খারাপ—এটাই হবে এখন। তারা নিজে নিজে আইন করলে তো হবে না। আইন করার একটি যথাযথ পদ্ধতি আছে। সে পদ্ধতি অনুসরণ না করে নিজেদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করার জন্য যদি আপনি নিজে নিজে একটি আইন বানিয়ে দেন, সে ক্ষমতা তো আপনি ব্যবহার করতে পারবেন না। শুধু যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তা না; আর্থিক সেক্টর শুধু না, অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরেও একই অবস্থা।
কালবেলা: স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি কী হবে? আবার যদি গভর্নর মন্ত্রীর মর্যাদায় চলে যান, তাহলে এটি ইন্টারমিনিস্টারিয়াল কাজকর্মগুলোর ক্ষেত্রে, সেই গভর্নরের ক্ষেত্রে, তিনি যদি ইচ্ছা করেন, একজনকে চাপিয়ে দিতে পারেন। আপনার দৃষ্টিতে এটি ঠিক হচ্ছে কি না বা কতটা স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন?
মিন্টু: প্রত্যেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপার আছে। যদি আমেরিকায় যান, দেখবেন যে, ওখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর-এগুলো এক একটি ১৫ বছরের জন্য একসঙ্গে, যাতে করে সরকার আসলে না বদলাতে পারে। আমরা এখানে শাখা বলি—ওখানে ওরা ইন্ডিপেনডেন্ট টাইপ বলে, ওখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন ১২টি ইন্ডিপেনডেন্ট টাইপ আছে; একটি তো ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, তাদের আন্ডারে আছে ১২টি। এই ১২টায় যে পরিচালক নিযুক্ত হয়, এরা কিন্তু প্রাইভেট সেক্টর থেকেও নিযুক্ত। শেয়ারহোল্ডারদের ভোটেও কিছু হয়। সে হিসাবে এই ১২টা হলো আবার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ওই বিভিন্ন কমিটির সদস্য বা গভর্নর। এখন এখানে মনিটরি পলিসি কে বানায়, আজও জানি না। পাবলিক বহুবার বলছে যে, আপনারা যে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সংকুচিত মুদ্রানীতি ফলো করছেন, বা নতুন একটা ওয়ার্ড (শব্দ) আছে ‘একোমোডেটিং মুদ্রানীতি’; এখন প্রশ্নটা হলো এগুলো কারা বানাচ্ছে, সেটার তো কোনো সংস্কার দেখলাম না। এমনকি ইন্ডিয়াতে মনিটরি পলিসি কমিটি আছে; এখানেও হয়তো আছে, কিন্তু ওরা নিজেরা নিজেরা কমিটি করলে তো হবে না। সেখানে মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সের লোক আছে, সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোক আছে, বাইরের লোকও আছে। এখানে তারা নিজেরা নিজেরা করেন, এগুলো তো সংস্কার করছেন না। আপনি ক্ষমতা যতই নেন— প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা থাকলেও যারা প্রতিষ্ঠান চালায়, তারা যদি সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে না জানে বা তাদের মানসিকতা যদি সাবসারভিয়েন্ট হয়—যেমন সরকার যা বলবে তাই ঠিক; তাহলে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে লাভ কী, ক্ষমতা দিয়ে লাভ কী? আপনি তো ক্ষমতাটা ব্যবহার করবেন, যারা ক্ষমতায় আছে তাদের সুবিধার জন্য, যেটা বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৫ বছর করেছে, ওদের ক্ষমতা তো কম ছিল না; কিন্তু এই ক্ষমতাগুলো কীভাবে ব্যবহার করল—সরকার যেটা চাইছে, সরকারের লোক যেটা চাইছে, সরকারের সমর্থনপুষ্ট লোক যেটা চাইছে, সেটাই অ্যাপ্রুভ হয়ে আসছে; আর যারা সরকারবিরোধী ওদের কিছুই অ্যাপ্রুভ হয়নি। এটা হলো তাদের ক্ষমতা। এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়া দেশের জন্য কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে খুবই নেতিবাচক।
কালবেলা: আপনি বিজনেস কমিউনিটির লোক, অন্যভাবে দেখলে আপনি একজন রাজনীতিবিদও। আসন্ন নির্বাচনে আপনি আপনার দল বিএনপি থেকে সরাসরি নির্বাচন করছেন, আপনি নির্বাচিতও হবেন বলে আমরা আশা করি। আগামীতে যদি আপনাদের দল অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়, সেক্ষেত্রে এই পলিসিগুলো চেঞ্জের ক্ষেত্রে আপনার কতটা ভূমিকা থাকবে কিংবা এ ক্ষেত্রে আপনি কতটা সক্ষম হবেন বলে মনে করেন? কারণ, এখানে আমলাতন্ত্র আছে, রাজনৈতিক মতভিন্নতাও রয়েছে।
মিন্টু: বাংলাদেশে তো প্রধান প্রতিবন্ধকতা আমলাতন্ত্র। সবাই বলে, সত্য-মিথ্যা পরে যাচাই হবে। এটার কোনো সংস্কার করছে? সংস্কার নিয়ে বলা যায় আমি তো যুদ্ধ করছি ২০০০ সাল থেকে। ২০০৪ সালে আমি ফরমালি পাবলিকলি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি; সেটা নিয়েও তো আমার ওপরে বেশ কিছু হয়েছে; কিন্তু আমি তো সংস্কার সংস্কার করে আসলাম। এই সরকার তো এসে বলেছে যে, আমরা সংস্কার করব। তো কী সংস্কার করবে? এখন সংস্কারে যাদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে, কেউ ভাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। তবে আমার যদি সুযোগ হয়, আল্লাহ যদি সে সুযোগ দেন, আমি পারসোনালি বিজনেস কমিউনিটির পক্ষে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে যতটুকু করার—সেটা অবশ্যই আমি করব। তাছাড়া আমার তরফ থেকে সংস্কারের ব্যাপারে যতটুকু বলার কথা, চেষ্টা করার কথা, সেটা তো আমি করবোই; কিন্তু আমরা যেভাবে বলি, সংস্কার এভাবে হয় না। তাছাড়া এটা তো একক ব্যাপারও না, সংস্কারের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্য দরকার হয়; কিন্তু ইদানিংকালে এ সংস্কার সংস্কার করে জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে জাতীয় অনৈক্য বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা কীভাবে সামাল দেবে, আমি জানি না। এটা সামলানোর পরেই না আমাদের রোলটা (ভূমিকা) আসবে।
কালবেলা: বাংলাদেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সেক্টরে আপনার একটা বড় অবদান ছিল। এখন বলতে গেলে ঘরে ঘরে সব জায়গায় হচ্ছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। এ অবস্থায় আসলে বাংলাদেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির আদৌ কোনো দরকার আছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাইব, আসলে বাংলাদেশে কেমন এডুকেশন পলিসি থাকা দরকার বা এটা কী হওয়া উচিত?
মিন্টু: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যত বাড়ে, ততই ভালো। প্রতিষ্ঠান ছাড়া তো শিক্ষা দেওয়া যাবে না; কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিজেদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মনে করে, তাহলে এটা বিরাট সমস্যা। আমি দেখছি—অধিকাংশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি যেভাবে চলছে, তারা এখন নিজেদের একটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরে নিচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করতে হবে। ২০০০ সালে আমাদের জীবনমান যেমন ছিল, তার থেকে বর্তমানে সেটা এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০০ সালে কিন্তু ইন্টারনেট ছিল না, আর এখন মানুষ ঘরে বসেও কাজ করতে পারে। এখন নতুন আসছে চ্যাটজিপিটি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এখানে মানুষ না থাকলেও গলার স্বর সব শোনা যায়। প্রত্যেক প্রজন্ম এখন তার আগের প্রজন্ম থেকে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর।
কিন্তু এখনকার সমস্যা যেটা, সেটা হলো—৮ হাজার বছর ধরে মানুষ একই যুগে বাস করছে, যেটাকে আমরা বলি কৃষিযুগ। তার পরবর্তীকালে প্রথম শিল্পযুগের সূচনা হয় ১৮৫০ সালে, ১৮০০ সাল থেকে শুরুও বলা যায়। এরপর দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব চলে আসছে কিন্তু ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে। প্রযুক্তি মানে এখন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি আসছে। প্রতি ২০ বছর পর পর এখন যুগের পরিবর্তন হচ্ছে। একদিক দিয়ে নতুন প্রজন্ম নতুন প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে—এ অবস্থায় এখন আমি যদি শুধু সেই আগের সমাজবিজ্ঞান, আগের ইসলামের ইতিহাস, আগের ফিজিক্স পড়াই—কোনো লাভ হবে না। কারণ, নতুন নতুন উদ্ভাবনী ছাড়া, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনী ছাড়া কোনো সমাজ কোনোদিন নিজেদের উন্নত করতে পারবে না। আর আমরা নিজেরা যদি উদ্ভাবন করতে না পারি, তাহলে অন্তত যারা উদ্ভাবন করছে, সে প্রযুক্তি ব্যবহার করার যোগ্যতা-দক্ষতা থাকতে হবে। বাংলাদেশে এখন যে শিক্ষার পদ্ধতি বা শিক্ষার ব্যবস্থা—তাতে আমাদের না উদ্ভাবনী শক্তি হবে, না এগুলো ব্যবহার করার কোনো যোগ্যতা থাকবে। হ্যাঁ, কিছু লোক পারবে, যারা তাদের ছেলেমেয়েদের ইন্টারমিডিয়েট পাস করলে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেটার হার কত, ০০১ শতাংশ। আপামর জনগণের ছেলেমেয়ে যারা আছে, তারা যে শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পাচ্ছে, তাতে তারা প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করতে পারবে না। সেজন্যই প্রতিষ্ঠানও দরকার, প্রতিষ্ঠানের আবার পরিবর্তনও দরকার—যাতে করে আমাদের ছেলেমেয়েদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা দিতে পারি।