Image description
ডিক্যাবে জার্মান রাষ্ট্রদূত

এয়ারবাস উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এলে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর বাণিজ্য সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব এবং জিএসপি-প্লাসসহ ভবিষ্যৎ শুল্কছাড় আলোচনার পরিবেশ বদলে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লোটজ। গতকাল বুধবার রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত ‘ডিক্যাব টক’ শীর্ষক আলোচনায় এমন আশঙ্কার কথা জানান জার্মান রাষ্ট্রদূত। আর এটি হলে তা হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, ইউরোপই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার।

ডিক্যাব টকে একই সঙ্গে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা জরুরি উল্লেখ করে রুডিগার লোটজ প্রত্যাশা করেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে।

এদিনের আলোচনায় অংশ নেন ডিক্যাব সভাপতি এ কে এম মঈনুদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান মামুন।

জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অর্থ হলো জনগণের ভোট দেওয়ার পূর্ণ সুযোগ নিশ্চিত করা এবং কাউকে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত না করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ভোটারের অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করাই এর মূল শর্ত। আমি মনে করি, আমরা সেটিরই প্রস্তুতি দেখতে পাচ্ছি।’

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়া জরুরি উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত লোটজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যেন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারে, সহিংসতা থেকে বিরত থাকে। ভোটাররা যেন ভয়মুক্ত পরিবেশে মতপ্রকাশ করতে পারেন এবং বিদেশে থাকা ভোটারদের অংশগ্রহণসহ ভোটের সঠিক গণনা হয়। এটাই মোটামুটি প্যাকেজ, যা আমি দেখতে চাই।’ উচ্চ ভোটদানের হার নির্বাচনকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, বিভিন্ন দেশে ভোটদানের হার সাধারণত ৫০-৮০ শতাংশের মধ্যে থাকে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘যত বেশি, তত ভালো। ৫০-৬০ শতাংশ ভোটদানও ইতিবাচক সংকেত।’

বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত। সিকিউরিটি সেক্টর, আইনের শাসন, শ্রম পরিবেশ, প্রশাসনিক কাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস এবং দক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট ইচ্ছা আন্তর্জাতিক অংশীদাররা লক্ষ্য করছেন।’

তার মতে, আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে আরও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্কের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।

এয়ারবাস কেনা ইস্যুতে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক প্রভাব জড়িত বলে মনে করেন বাংলাদেশে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটজ। তিনি বলেন, ‘এয়ারবাস নিয়ে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।’

এয়ারবাস কেনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এর প্রভাব বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর পড়বে কি না—জানতে চাইলে রুডিগার লোটজ বলেন, ‘অবশ্যই পড়বে। আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক অংশীদার এবং এতদিন যেভাবে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা হয়েছে, আমরা চাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। ব্যবসায়ে টেকসই সম্পর্ক খুব জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘অবশ্য এটি বাংলাদেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কিন্তু ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক জীবনে যেমন হয়, প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই সামগ্রিক পরিবেশ ও মনোভাবের ওপর কিছু না কিছু প্রভাব পড়ে। আমরা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখব, কারণ এটি দুপক্ষেরই স্বার্থে। তবে আপনি যদি জানতে চান যে, এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না—কিছুটা প্রভাব অবশ্যই পড়বে।’

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এয়ারবাস অসাধারণ পণ্য তৈরি করে। আমি তাদের প্রতিনিধি নই, তবে আমি মনে করি অ্যাভিয়েশনের বাজার সম্প্রসারণে এটি একটি সেরা পছন্দ হতে পারে।’

রুডিগার লোটজ বলেন, ‘এর পেছনে আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন জিএসপি-সংক্রান্ত আলোচনা—এগুলো কাউকে হুমকি দেওয়ার বিষয় নয়, মোটেও না। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত সিদ্ধান্তগুলো আংশিকভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তাই জিএসপি-প্লাস আলোচনার অগ্রগতি বা সিদ্ধান্ত, এয়ারবাস নিয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ঘিরে সামগ্রিক পরিবেশে প্রভাব ফেলে।’

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা দেওয়ার সময় আরও কমিয়ে আনার কথা উল্লেখ করেন জার্মান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভিসার বিষয়টি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। অনেক শিক্ষার্থী জার্মানিতে পড়তে যেতে চায়। আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে ভিসা দেওয়ার সময়টাকে কমিয়ে আনা যায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশি ভিসাপ্রার্থী আছে, তাদের কাছে আমরা সহযোগিতা চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের চাওয়া ভিসাপ্রত্যাশীরা সঠিক তথ্য দিক। কারণ, অনেক সময় তারা জাল কাগজপত্র দেন, যার ফলে আমাদের যারা ভিসা দেন, তাদের এসব যাচাই-বাছাই করতে অনেক সময় লাগে। অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা সঠিক কাগজ দেন। কিন্তু যারা জাল কাগজপত্র দেন তাদের কারণে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন ভিসা প্রাপ্তির সুযোগ সীমিত হয়ে আসে।’

এ সময় ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাম্প্রতিক রায় নিয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটস বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব পরিস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। ক্ষমতার অপব্যবহার মোকাবিলার যে কোনো প্রচেষ্টা অবশ্যই আইনের মৌলিক নীতি মেনে পরিচালিত হতে হবে। আইনগত প্রক্রিয়া অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া জরুরি।’

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল জার্মানি। পঁচাত্তরের মতো বর্তমান প্রেক্ষাপটেও শেখ হাসিনাকে জার্মানি আশ্রয় দেবে কিনা— এ প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘১৯৭৫ সালে কি হয়েছিল, এটা অনেক পুরোনো ঘটনা। এটা যে আবারও ঘটবে সেটা নির্ভর করছে আলোচনার ওপরে। বিষয়টি নিয়ে আমি আসলে জবাব দেওয়ার অবস্থানে নাই।’

রুডিগার লোটস বলেন, ‘যখন আইনি বিষয়টি আসে আমি মনে করি, সেটাকে আইনিভাবে মোকাবিলা করা দরকার। অতীতে যদি ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে, সেটা আইনিভাবে লড়াই করা উচিত। এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর যে কোনো দেশের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। বিগত সরকারের প্রতিনিধিত্ব যারা করেছেন, তারা এখনো স্বীকার করছেন না, তাদের কিছু সিদ্ধান্তে ভুল ছিল।’

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে তাদের বহরে এয়ারবাস যুক্ত করতে কিছুদিন আগে যৌথভাবে আহ্বান জানান যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা। তাদের যুক্তি, বহরের এ বৈচিত্র্য জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির ফ্লেক্সিবিলিটি, প্রতিকূলতা মোকাবিলার সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ফ্রাঙ্কো-জার্মান দূতাবাসে এয়ারবাসের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইউরোপিয়ান ডায়ালগ অন বাংলাদেশ এভিয়েশন গ্রোথ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানানো হয়। তারা ইউরোপে কয়েক বিলিয়ন ইউরোর বাংলাদেশি পণ্যের বাজার, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ, যুক্তরাজ্যের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এবং দীর্ঘ অংশীদারত্বের কথা মনে করিয়ে দেন বারবার। সব মিলিয়ে বিমানের জন্য উড়োজাহাজ কেনার যে আলাপ চলছে, সেখানে ইউরোপীয় কোম্পানি এয়ারবাসকে রাখার চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের খড়্গ থেকে বাঁচতে গত জুলাই মাসে অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে। এতে ফ্রান্সের কোম্পানি এয়ারবাস থেকে বিমানের জন্য ১০টি বড় উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এয়ারবাস কেনার ওই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে ২০১৪ সালের আগস্টে সরকার বদলের পর সে উদ্যোগে তেমন কোনো গতি দেখা যায়নি। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ট্রাম্পের চাপের মুখে গত জুলাই মাসে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান আগের সিদ্ধান্ত বদলের কথা জানান। বিমানের জন্য ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার করার কথাও তিনি জানান। এরপর ইউরোপও নড়েচড়ে বসে। এয়ারবাস বিক্রির জন্য তারাও চাপ দিতে থাকে সরকারের ওপর। গত জুন মাসেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে গেলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এয়ারবাসের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ভাউটার ভ্যান ভার্স। এর পর থেকে কোম্পানির প্রতিনিধিরা সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।