ইসলামী ব্যাংকের ৯৬৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ঋণসহ মোট ১ হাজার ৯২ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ডিসেম্বরে একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তত ৮ জন কর্মকর্তার দায় খুঁজে পেয়েছে দুদক।
দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করছে, ওই কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে অবৈধভাবে ঋণ মঞ্জুরে সহায়তা করেছেন অথবা তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। এসব দিক বিবেচনায় ওই ৮ কর্মকর্তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। একই সঙ্গে এই ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে সেটি অবগত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠায় দুদক। তবে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো কোনো দায় নেই উল্লেখ করে ওই ৮ কর্মকর্তাকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান থেকে অব্যাহতি দিতে ‘বিশেষ অনুরোধ’ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি দুদকের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ ও চাপে রাখার কৌশল, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে—সেটি একান্তই দুদকের এখতিয়ারাধীন বিষয়। দুদকের অনুসন্ধান বা তদন্তাধীন বিষয়ে নির্দেশনা, অনুরোধ বা ‘বিশেষ অনুরোধ’—এমন কোনো কিছু করারই আইনগত বৈধতা নেই।
নথিপত্রে উল্লেখ থাকা তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাকতাই শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়। এর ৯ দিন পরে ২ ডিসেম্বর ওই হিসাব থেকে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দের আবেদন করা হয়। আবেদনকারীর আবেদন যাচাই-বাছাই না করেই শাখা অফিস তা হেড অফিসে পাঠিয়ে দেয়। সব প্রক্রিয়া ‘রকেট গতিতে’ সম্পন্ন করে সৃজন করা হয় নকল দলিলপত্র। সব মিলিয়ে মাত্র ২১ দিন পরে ১৪ ডিসেম্বর গ্রাহকের চাহিদামাফিক ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। এরপর ২১, ২২, ২৩ ও ২৬ ডিসেম্বর—মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ৮৯০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। এ ঋণে সাধারণ গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিতে পড়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে এ ঘটনায় গত বছরের ডিসেম্বরে ৫৮ জনকে আসামি করে মামলা করে দুদক। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ঘটনার সময় নিষ্ক্রিয় থাকা, যোগসাজশ কিংবা দায়িত্বে অবহেলার প্রাথমিক প্রমাণ পান দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
ওই ৮ কর্মকর্তা হলেন—প্রধান কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক লেনিন আজাদ পলাশ, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ, অতিরিক্ত পরিচালক (ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ, উইং-৬) মো. মঞ্জুর হোসেন খান। চট্টগ্রাম কার্যালয়ের রয়েছেন চারজন, যাদের সবাই যুগ্ম পরিচালক। তারা হলেন: সুনির্বাণ বড়ুয়া, মো. জোবাইর হোসেন, অনিক তালুকদার ও রুবেল চৌধুরী। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের তৎকালীন আরও একজন যুগ্ম পরিচালক রয়েছেন দুদকের তালিকায়, যিনি বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক।
এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠায় দুদক। কমিশনের তৎকালীন সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইসি কমিটির পরিচালক আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে নিজে লাভবান হয়ে অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রেকর্ডপত্র সৃজনপূর্বক তা ব্যবহার করে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, চাকতাই শাখা, চট্টগ্রাম থেকে ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
এ ছাড়া আত্মসাৎকৃত অর্থের প্রকৃত উৎস ও প্রকৃতি গোপন করার নিমিত্তে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭/১০৯ তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় কমিশনের অনুমোদনক্রমে দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রামে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপরোল্লিখিত কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ‘এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে অনুসন্ধান টিম সুপারিশ করে, যা দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। এ অবস্থায় (ফের ওই ৮ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে) এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক গৃহীত ফল এ কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’ চিঠির সঙ্গে ১৪ পাতার সংযুক্তি দেওয়া হয়, যেখানে ওই ৮ কর্মকর্তার দায়-দায়িত্ব লেখা রয়েছে। এ সংক্রান্ত সব কাগজ কালবেলার হাতে রয়েছে।
অন্যদিকে, এই ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এ সংক্রান্ত দুদকের উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাতকে প্রধান করে ৩ সদস্যের দল গঠন করা হয়।
এরপর অনুসন্ধান সংক্রান্ত বিষয়ে দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে বেশ কিছু চিঠি আদান-প্রদান হয়। দুদক থেকে বিভিন্ন সময়ে ওই ৮ কর্মকর্তার বিভিন্ন তথ্য চেয়ে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব চিঠির আংশিক জবাব দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি না দিয়ে বরং সময় বৃদ্ধির আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব বিষয় উল্লেখ করে ফের গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি চিঠি দেন দুদকের উপপরিচালক মো. ইয়াছির আরাফাত। সেই চিঠিতে বলা হয়, ‘সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে আপনার প্রতিষ্ঠানের ৮ জন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথি এবং ছক অনুযায়ী তথ্যাদি (পূর্বে প্রেরিত ছক) পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, দুদক স্মারক নং -১১৭৫১, তারিখ-২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এবং স্মারক নং-১৬৬৫২, তারিখ-১৬ মার্চ ২০২৫ মূলে আপনার দপ্তরে বর্ণিত বিষয়ে পত্র প্রেরণ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট-২ থেকে স্মারক নং-২৭৫৬, তারিখ-২৭ মার্চ ২০২৫ মূলে পূর্বের চাহিত তথ্যাদি এবং বর্ণিত কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নথির সত্যায়িত ফটোকপি প্রেরণের জন্য ৩ মাস সময় প্রয়োজন মর্মে একটি পত্র নিম্নস্বাক্ষরকারী কর্তৃক গৃহীত হয়।
পরবর্তী সময়ে, দুদক স্মারক নং-৩৩৯১৬, তারিখ-২ জুলাই ২০২৫ মূলে একটি তাগাদা পত্র প্রেরণ করা হয়। বিগত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট-২-এর পারফরম্যান্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন উইং থেকে স্মারক নং-৫৫৯৭, তারিখ-২০ জুলাই ২০২৫ মূলে ৮ জন কর্মকর্তার মধ্যে ৪ জন কর্মকর্তার তথ্যাদি প্রেরণ করা হলেও নিম্নবর্ণিত অবশিষ্ট ৪ জন কর্মকর্তার তথ্যাদি প্রেরিত ছকানুযায়ী ও ৮ জন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথির সত্যায়িত ফটোকপি প্রেরণ করা হয়নি। ফলে অনুসন্ধান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’ চিঠিতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ১৯(১)(খ) ধারায় ওই কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি ‘অতীব জরুরি’ বলেও উল্লেখ করা হয়। এই চিঠির জবাবে ওই ৮ কর্মকর্তার কোনো দায় পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে চলমান জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ‘বিশেষ অনুরোধ’ করে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (এইচআরডি) নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনাদের পত্রের প্রেক্ষিতে পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৬, চট্টগ্রাম অফিস এবং পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন থেকে মতামত সংগ্রহ করা হয়।’
মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, চট্টগ্রাম অফিস কর্তৃক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর চাকতাই শাখার ওপর ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ও ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখভিত্তিক পরিদর্শন এবং ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৬ কর্তৃক একই শাখার ওপর ২৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনগুলোতে এস আলম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট একটি গ্রাহকের অনুকূলে ঋণ সুবিধা প্রদান করার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর চাকতাই শাখার গুরুতর অনিয়মাদি পরিদর্শকরা প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরেন। চট্টগ্রাম অফিস ও ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৬-এর মতামত জবাব পর্যালোচনায় আরও দেখা যায় যে, পরিদর্শন দল কর্তৃক বর্ণিত অনিয়মগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানসহ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি বরাবর পত্র প্রেরণ করা হয়। ওই ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা যথাযথ না হওয়ায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০২৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ৪৬ এবং ১০৯ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। ফলে, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৬ ও চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিষয়ে দুদক কর্তৃক উল্লিখিত দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগের যথার্থতা পরিলক্ষিত হয় না। এ অবস্থায় আপনাদের ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখের স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাংকের ৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার বিষয়টি পরিলক্ষিত না হওয়ায় আপনাদের সংশ্লিষ্ট স্মারক সূত্রে উল্লিখিত ৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য আপনাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ওই কর্মকর্তাদের অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করেছে। তারা (দুদক) একসেপ্ট (গ্রহণ) করবে কি করবে না, এটা তাদের ব্যাপার। তারা তাদের মতো কাজ পরিচালনা করবে। যে কোনো ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হলে আরজি তো জানাতেই পারে।’ ব্যক্তির দায় অব্যাহতি দিতে প্রতিষ্ঠানের চিঠি দেওয়া অনৈতিক কি-না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তারা তো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছে। প্রতিষ্ঠান তাদের পক্ষ হয়ে রিপ্লাই (প্রত্যুত্তর) দিয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘আর একটা বিষয় খেয়াল করুন। তারা (৮ কর্মকর্তা) তো অফিসিয়াল কাজ করতে যাওয়ায় অভিযোগটা আসছে। এমন নয় যে ব্যক্তি পর্যায়ে কোনো অপরাধ করেছে। ব্যক্তির অপরাধের দায় তো প্রতিষ্ঠান নেবে না। এটা তো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করতে গিয়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। প্রশাসন তাদের বক্তব্য নিয়েছে এসব ব্যাপারে এবং দেখেছে যে, যে কারণে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, আমাদের কাছে সেটা জোরালো বা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। অতএব আমরা অনুরোধ করে দেখি তারা (দুদক) কী বলে।’
দুদক তো ওইসব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অবৈধ সম্পদ আছে কি না তা অনুসন্ধান করছে। এ থেকে তাদের অব্যাহতি বাংলাদেশ ব্যাংক চাইতে পারে কি না—এমন প্রশ্নে আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘অভিযোগ তো সেভাবে করেনি। তারা বলেছিল— আপনার সম্পদের বিবরণ দিন। তারা বলেননি যে আপনি অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ আছে। তারা বলেছেন যে, আপনারা বাবা-মা এমনকি শ্বশুর-শাশুড়ি সবার সম্পত্তির বিবরণ দিন। এখন একটা বিষয় হলো—দুদক আমাকে বলল, আমার শ্বশুরের সম্পদের বিবরণ দিন। আমার শ্বশুর যদি দিতে রাজি না হয়? এখন দুদক বলতে পারে না—আপনার কাছে যা চাওয়া হয়েছে তা দেননি? আপনি নির্দেশনা অমান্য করেছেন। হতে পারে না? আমরা বলেছি যে, বৃত্তের আকারটা যে বড় করেছেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে। এখন আমার বৃত্ত আনতে গিয়ে বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবার সম্পদের বিবরণ চাইতে পারেন না। চাইতে পারেন না, সে কথাও কিন্তু আমরা বলিনি। আমরা বলেছি, এই চাওয়া থেকে আমাদের নিষ্কৃতি দিন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাদের। আমরা অনুরোধ করেছি।’
যা বলছেন আইনজীবীরা: জানতে চাইলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) দেলোয়ার জাহান রুমি কালবেলাকে বলেন, ‘২৭/১ ধারায় অবৈধ সম্পদের ইনকোয়ারি (তদন্ত) করবে দুদক, বলবে দুদক। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা তারা দিতে পারেন না।’
রাষ্ট্রপক্ষের এই কৌঁসুলি আরও বলেন, ‘এর পরও যদি কেউ দেয়, তাহলে সেটা দুদকের আমলে নিতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।’
এই ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার কর্মকর্তাদের বেআইনিভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাদিম মাহমুদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এই চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তার কর্মকর্তাদের বেআইনিভাবে রক্ষার চেষ্টা করছে। দুদক যদি মনে করে কোথাও অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে বা হওয়ার পসিবিলিটি (সম্ভাবনা) আছে, সেখানে বা সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাতে পারে। তবে সেখানে দুদককে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানাধীন বিষয়ে কেউ অভিযুক্তর দায়মুক্তি চাইতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বলা উচিত ছিল— আপনারা অনুসন্ধান করুন। তাদের কোনো অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেলে আমাদের জানান। আমরা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব। ব্যাংকের টাকা জনগণের। এখানে রিকশাচালকের টাকা আছে, এখানে কৃষকের টাকা আছে। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সময় আপনি চুপ থাকবেন, আর পরে বলবেন—আমার ওপর চাপ ছিল। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এটা দুদকের কাজে হস্তক্ষেপ। দুদককে ইনডিরেক্টলি প্রেশার দেওয়া—এটা বেআইনি। দুদককে এ অনুসন্ধান চালাতে হবে। প্রয়োজনে আমরা হাইকোর্টে যাব।’
যা বলছে টিআইবি: শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, দুদকের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ দেশের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানই করতে পারে না বলে মনে করেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)- এর নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো অবস্থাতেই করতে পারে না। দুদকের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ, দুদকে প্রভাবিত শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বাংলাদেশের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানেই করতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এটা করে থাকে তাহলে কোনো অবস্থাতেই দুদককে এটা আমলে নেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে এ ধরনের চিঠি পাঠানোর কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’