Image description

আগে শীতকাল এলেই শোনা যেতো রাজধানীতে গ্যাস সংকট শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন আর শীত-গ্রীষ্ম নেই—প্রায় সারা বছরই গ্যাস সংকট লেগে থাকে। গত কয়েক মাস ধরে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে ঘরে ঘরে গ্যাসের অভাবে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীবাসী।

যদিও চাহিদা আর সরবরাহে ঘাটতিকে সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি সরবরাহ দৈনিক ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নামলেই সংকট দেখা দেয়। সোমবার (২৪ নভেম্বর) সারা দেশে এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে ৮৮২ মিলিয়ন ঘনফুট।

গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে গত কয়েক মাস ধরেই ঢাকার বেশিরভাগ এলাকার চুলা জ্বলছে না। কোনও কোনও এলাকায় ভোরে কিছুটা থাকলেও দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাস থাকছে না।

ঘরে ঘরে ভোগান্তি

লালমাটিয়ার বাসিন্দা রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘‘সকালেই গ্যাস চলে যায়, আসে রাতে। খুব ভোরে উঠে রান্না শেষ করতে হয়। এই গ্যাসের কারণে ছুটির দিনে দুপুরেও মেহমান দাওয়াত দেওয়ার সাহস পাই না। জরুরি দরকারের জন্য এরই মধ্যে ইলেকট্রিক চুলা কিনেছি।’’

একই এলাকার বাসিন্দা কাকলী তানভীর বলেন, ‘‘২০০৬ সাল থেকে আমি লালমাটিয়ায় থাকছি। আগে শীতকালে গ্যাসের চাপ কমে যেতো। কিন্তু এখন প্রায় সারা বছর গ্যাসের এই সমস্যা। সকালের নাস্তাটা কোনোমতে করা গেলেও দুপুরে এখন আর রান্না করি না। বিকালে রান্না করি। সেটা দিয়েই রাতের খাওয়া হয়, আর যা থাকে—সেটাই ওভেনে গরম করে পরের দিন দুপুরের খাবারটা চালিয়ে নিই। ভোগান্তি এখন চরমে গিয়ে ঠেকেছে। সামনে কীভাবে চলবো, কোনও বিকল্প ভেবে পাচ্ছি না।’’

রায়েরবাজার টালি অফিস রোডের বাসিন্দা হামিদা শশী বলেন, ‘‘ভোর থেকেই চুলার আঁচ কমতে শুরু করে। সকালের নাস্তা টিমটিম করে জ্বলা আঁচে কোনোমতে রুটি সেঁকে, ডিম ভেজে খাওয়া গেলেও দুপুরের রান্না আর করা যায় না। এরপর গ্যাসই থাকে না চুলায়। সন্ধ্যার পরও থাকে না। রাত ১১টার পর গ্যাস এলেও তা সামান্য। তা দিয়ে রান্না হয় না। বাধ্য হয়ে ইলেকট্রিক চুলা কিনেছি। ফলে খরচ বেড়ে গেছে। গ্যাসের চুলার পেছনে বিল দিই। আবার বিদ্যুতের পেছনে বাড়তি খরচ হচ্ছে। এ ভোগান্তি কবে যে শেষ হবে, তাও কেউ বলছে না।’’

রামপুরা উলনের বাসিন্দা সেলিম হাসান বলেন, ‘‘গ্যাসের সমস্যার কারণে সকালে এখন আর বাসায় নাস্তা বানানো হয় না। হয় আগে রাতের ভাত, অথবা হোটেল থেকে কিনে এনে চা নাস্তা করতে হয়। দুপুরের রান্না গিন্নি রাতেই সেরে রাখেন। সন্ধ্যার আগে গ্যাস পাওয়া যায় না। তবে আমার ছোট্ট বাচ্চা থাকায় মাঝে মাঝে চুলা জ্বালাতে হয়। তাই এলপিজির একটা সিলিন্ডার কিনে রেখে দিয়েছি। জরুরি প্রয়োজনে সেই চুলা ব্যবহার করি।’’

তিন এলাকার গ্যাসের সংকট এভাবেই তুলে ধরলেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু এছাড়াও পুরান ঢাকা, শংকর, জিগাতলা, চামেলীবাগ, মালিবাগ, ভূতের গলি, মগবাজারের ভেতরের দিকের এলাকা—এমনকি খোদ ধানমন্ডির কিছু এলাকায় সারা দিন ধরে একেবারেই গ্যাস থাকে না বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরবরাহ ঘাটতির কারণে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রেও গ্যাসের সরবরাহ কমানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও সামগ্রিক ঘাটতি মোকাবিলা করা কঠিন হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার হিসাব কী বলছে

২৪ নভেম্বর পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ সংক্রান্ত  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— ‘‘ওই দিন সারা দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা ছিল ২৪৮৭ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৭৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও এখন শীতের আগমনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের ব্যবহার কমার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমায় সংকট দেখা যাচ্ছে না। সাধারণত গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বা তার চেয়ে খানিকটা বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হয়।’’

পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, ‘‘দেশে মোট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সব মিলিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক সারা দেশে প্রতিদিন ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট।’’ বিপুল পরিমাণ এই ঘাটতির কারণে চরম ভোগান্তিতে আছেন এখন বাসাবাড়ির মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই। দেশের দুটি টার্মিনাল দিয়ে দিনে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও থাকলেও বাস্তবে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৮২ মিলিয়ন ঘনফুট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগতভাবে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এখন দেশীয় গ্যাস খনিগুলো থেকে মাত্র ১৭৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এই সরবরাহের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। গত কয়েক বছর ধরে যা অব্যাহতভাবে কমছে। সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও দেশের খনি থেকে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।

গত এক দশকে দেশের অভ্যন্তরে বড় গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ভোলা আবিষ্কৃত হলেও ওই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনা সম্ভব হয়নি। সরকার সম্প্রতি ভোলায় সার কারখানা এবং শিল্প এলাকা গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কথা বলছে। ফলে ভবিষ্যতেও ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনার সম্ভাবনা কম। গ্রিডের মধ্যে বিশাল সাবসি পাইপ লাইন নির্মাণকে ব্যয়বহুল হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে সরকার ভোলা-বরিশাল সেতু উন্নয়নের কথা বলছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আসতে পারে। তখন সেতুর সঙ্গে পাইপ লাইন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিলেই সেটি সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে পাইপ লাইন নির্মাণ করায় উত্তরের জেলাগুলোতে গ্যাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা আরও মনে করেন, ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হলে চাহিদার সঙ্গে ঘাটতি কমানো যেত। যদিও সেটি দীর্ঘমেয়াদি এক ব্যয়বহুল পরিকল্পনা।

সম্প্রতি পেট্রোবাংলা জানায়, ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে ৫০টি ও ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে ১০০টি কূপ খনন ওয়ার্কওভার কর্মপরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন ব্লকে অনুসন্ধান ও নতুন কূপ খননের কাজ জোরদার করা হয়েছে।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, পুরোনো কূপে গ্যাস অনুসন্ধান করে গ্যাস পাওয়া গেলেও তা পরিমাণে খুব বেশি আসবে না। অপরদিকে নতুন কূপে গ্যাস পেলে সেটি উত্তোলন করে গ্রিডে আনতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।

যা বললেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

গ্যাস ভয়াবহ ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর)  রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘গত বছরের তুলনায় উৎপাদন কমেছে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই ঘাটতির রেশ তো সব খাতেই পড়বে।’’ তিনি বলেন, ‘‘তিতাসের অধীন এলাকায় গ্যাসের চাহিদা প্রায় ২ হাজার ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ১ হাজার ৫০০ মিলিয়নের মতো। এই গ্যাস আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র, কারখানা, শিল্প, বাণিজ্য, সিএনজি এবং আবাসিকে সরবরাহ করি। এর মধ্যে আবাসিকে ১২ শতাংশের মতো সরবরাহ করা হয়৷’’

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘‘চাহিদার তুলনায় গ্যাস কম পাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে আমরা রেশনিং করতে বাধ্য হই। এ কারণে আবাসিকে গ্যাসের সমস্যা আগের চেয়ে বেড়েছে।’’ সমস্যার সমাধান কীভাবে এবং কবে নাগাদ হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি যত কম হবে, সরবরাহ ব্যবস্থা তত ভালো হবে।’’