বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চৌধুরী মঈনুদ্দীনের কাছে বৃটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় হাইকোর্টে সরাসরি ক্ষমা চেয়েছে। একই সাথে দুই লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড জরিমানা দিতে সম্মতি জানিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনজীবী রয়েল কোর্ট অব জাস্টিসের একটি বেঞ্চে উপস্থিত হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে জরিমানা পরিশোধে সম্মতি জানিয়েছে।
মানহানির মামলায় দীর্ঘ বছর ধরে চালিয়ে নেওয়ার পর মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মামলার বর্ণনায় জানা যায়, ২০১৯ সালে কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের ‘চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম’ বিষয়ক ব্রিটিশ হোম অফিসের ওয়েবসাইটে চৌধুরী মুঈন উদ্দিনকে এক্সটিমিজমের সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়। এতে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তৎকালীন বিতর্কিত আইসিটি মামলার রায়কে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
হোম অফিসের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন প্রকাশের পরই চৌধুরী মুঈন উদ্দিন ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোন রকম মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে তিনি জড়িত নন। বরং বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সেই মামলার প্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ জুন সুপ্রীম কোর্ট তার পক্ষে রায় দেয়।
সেই রায়ের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্টতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের যে অভিযোগ হোম অফিস ইতোপূর্বে প্রকাশ করেছিল, তা মিথ্যা ছিল বলে উল্লেখ করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে বৃটিশ সরকার। একইসাথে তাকে ব্রিটিশ মুদ্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩ কোটি ষাট লক্ষ টাকা) অর্থ ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছে।
মামলা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এটা ব্রিটিশ সরকারের কোনও বিভাগ কর্তৃক তার নাগরিককে প্রদত্ত সর্বোচ্চ মানহানি ক্ষতিপূরণগুলোর একটি। যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি লর্ড রিড এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচারক প্যানেল ২০২৪ সালে ঐ মামলায় মঈনুদ্দিনের পক্ষে সর্বসম্মত রায়ে মন্তব্য করেছিলেন: যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের চেয়েও গুরুতর অভিযোগ নিজের নাগরিকের বিরুদ্ধে কল্পনা করা কঠিন। যখন এই ধরনের অভিযোগ সরকারের পক্ষ থেকে তার নিজের নাগরিকের বিরুদ্ধে আনা হয়, তখন তা বিশেষভাবে গুরুতর।
চৌধুরী মঈনুদ্দিনের আইনজীবী টিউডর আদালতে বলেন, প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে মানবজাতির সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরে তাকে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগ দায়েরের সময় মঈনুদ্দিন আশা করেছিলেন যে, হোম সেক্রেটারি দ্রুতই বুঝতে পারবেন যে এই প্রকাশনা অন্যায় ও অযৌক্তিক ছিল এবং দ্রুত সংশোধন করবেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হোম অফিস দাবি খারিজের চেষ্টা করে, যা বহু শুনানি এবং শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। এতে ছয় বছর ধরে মঈনুদ্দিনের মানহানি ও মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে। এই ছয় বছরে কখনোই হোম অফিস অভিযোগ সত্য বলে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি, কারণ তার কোনো ভিত্তিই ছিল না।
এর আগে ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানি মামলায় যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট তার পক্ষে যুগান্তকারী সর্বসম্মত রায় দেয়। ২০ জুন ২০২৪ সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট (প্রধান বিচারপতি) লর্ড রিড আদালতের পক্ষে এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে জরিমানা নির্ধারণ করেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের পর, হোম সেক্রেটারি/হোম অফিস ‘অফার অব অ্যামেন্ডস' প্রদান করে, যার ভিত্তিতে হোম অফিস তাদের ওয়েবসাইটে ক্ষমাপ্রার্থনা প্রকাশ করে। এর প্রেক্ষিতেমঙ্গলবার উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা আদালতে একটি যৌথ বিবৃতি পড়ে শোনান।
শুনানির পর মঈনুদ্দিন বলেন: এই ফলাফল আমার জন্য আনন্দের, গৌরবের। সত্যের প্রভাব যে চিরস্থায়ী- তা আবারো প্রমাণিত হলো। আমি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলাম যে, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি আশা করেছিলাম, হোম সেক্রেটারি দ্রুত ভুল সংশোধন করবে এবং ক্ষমা চাইবে। ন্যায়বিচার পাওয়ার এই দীর্ঘ পথে অনেক সময়ই আমার জন্য হতাশাজনক ও মানসিকভাবে কষ্টদায়ক হয়েছে। তবে আমি আনন্দিত যে বৃটিশ আইনব্যবস্থা, আদালত ব্যবস্থা এবং এই দেশের সরকার আমার প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে।
চৌধুরী মঈনুদ্দিন’র পক্ষে বিখ্যাত ল’ফার্ম কার্টার-রাকের আইনজীবী অ্যাডাম টিউডর ও নাতাশা ডোলির নেতৃত্বে জ্যাকব ডিন ও লিলি ওয়াকার-পার-এর সমন্বয়ে গঠিত একটি আইনজীবী দল প্রতিনিধিত্ব করেন।
উল্লেখ্য, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের নাগরিক। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে সবসময়ই সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি দাবি করেছেন বিভিন্ন সময়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার চার দশকেরও বেশি সময় পর তার “দোষী সাব্যস্তকরণ” আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, আইনপ্রণেতা এবং বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিকট সর্বজনীনভাবে নিন্দিত হয়েছিল। কারণ এটি ন্যূনতম বিচারিক ন্যায্যতার নীতিও অনুসরণ করেনি।
এই রায়ের মাধ্যমে বৃটেনের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে নজির স্থাপন করলেন বৃটেনের বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দিন।