 
              প্রাথমিক স্তরেই শিশুদের শিক্ষার ভিত্তি গড়ে ওঠে। কিন্তু যাদের হাত ধরে সেই ভিত্তি রচিত হয়, দেশের সেই প্রাথমিক শিক্ষকেরাই এখনো সরকারি কাঠামোতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ রয়েছেন। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস একজন গাড়িচালকের গ্রেড যেখানে ১২তম, সেখানে স্নাতক-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকের গ্রেড ১৩তম। গ্রেড অনুযায়ী তাদের মূল বেতন মাত্র ১১ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে সর্বসাকল্যে একজন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক মাসে পান প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ টাকার মতো।
এদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতনেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে সর্বনিম্ন। দেশের সহকারী শিক্ষকদের গড় বেতন ১২৩ ডলার, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ১১২ ডলার কম।
উচ্চমূল্যের বাজারে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনে পরিবার চালানো একজন প্রাথমিক শিক্ষকের জন্য হয়ে উঠেছে ‘পাহাড়সম কঠিন’ কাজ। শিক্ষকদের অভিযোগ, দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব পালন করেও তারা ন্যায্য মর্যাদা ও জীবনমান থেকে বঞ্চিত।
বর্তমানে দেশে ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর রয়েছে, যার সাথে ২০২৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে সামান্য ভাতা সমন্বয় করা হয়েছে। এ স্কেলের আওতায় স্কুল-২ পর্যায়ের জুনিয়র শিক্ষকদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৬তম গ্রেডে ৯ হাজার ৩০০ টাকা মূল বেতন দিয়ে। ন্যূনতম ২ হাজার টাকা বাড়িভাড়া ভাতা ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা যোগ করে তাদের মোট বেতন হয় ১১ হাজার ৮০০ টাকা, যা মাত্র ৯৭ ডলারের সমান।
বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ক সহকারী শিক্ষকদের মূল বেতন ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু। বিভিন্ন ভাতা যোগে তাদের মোট বেতন দাঁড়ায় ১৫ হাজার টাকা, যা ১২৩ ডলার। বিএড ডিগ্রিধারী বিশেষায়িত বিষয় শিক্ষকরা ১০ম গ্রেডে ১৬ হাজার টাকা বেতন নিয়ে যোগদান করেন। নভেম্বর ২০২৫ থেকে তাদের মোট বেতন দাঁড়াবে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা (১৫২ ডলার) এবং জুলাই ২০২৬ এ বাড়িভাতা মূল বেতনের ১৫ শতাংশে উন্নীত হলে তা হবে ১৮ হাজার ৯০০ টাকা (১৫৫ ডলার)। শুরু থেকেই ১০ শতাংশ পেনশন কর্তন প্রযোজ্য। প্রতিবছর জুলাইয়ে মূল বেতনে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, বছরে দুইটি উৎসব ভাতা (প্রতি ভাতা ২৫ শতাংশ), এবং একটি বৈশাখী ভাতা (২০ শতাংশ) দেওয়া হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১০ বছর পর সহকারী শিক্ষকরা ৯ম গ্রেডে ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হিসেবে উন্নীত হন, যেখানে মূল বেতন শুরু হয় ২২ হাজার টাকা থেকে।
 
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ শিক্ষকদের বেতন প্রদানে সবচেয়ে পিছিয়ে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে শিক্ষক পেশাকে মধ্যবিত্ত মর্যাদার পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সেখানে শুরুতেই উচ্চ বেতন নিশ্চিত করা হয়। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই দাপ্তরিক সহকারীদের নিচে অবস্থান করেন। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) বিবেচনায় এই ব্যবধান আরও প্রকট।
এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি বেতন দেওয়া হয়। ইন্দোনেশিয়া ও চীন শিক্ষক সার্টিফিকেশন ও আবাসন সুবিধা প্রদান করে প্রকৃত আয় বাড়িয়ে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলোতে শিক্ষকতা উচ্চ মর্যাদা ও উচ্চ বেতনের পেশা, এটি শিক্ষার মানেও প্রভাব ফেলে।
 
ওইসিডি সদস্য দেশগুলোতে শিক্ষকতা মানবসম্পদ বিনিয়োগের জায়গা হিসেবে গণ্য করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে শিক্ষক বেতন মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রা হিসেবে দিয়ে থাকে। উন্নত পেনশন, পেশাগত প্রশিক্ষণ সুবিধা এবং উচ্চ বেতন ধারাবাহিক শিক্ষাগত সাফল্য নিশ্চিত করে এসব দেশে।
২০২৫ সালের ২৪ জুলাই গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ৯ম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করছে। প্রাথমিকভাবে মূল বেতন ও অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। এতে সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় (১৪৮–১৬৪ ডলার) উন্নীত হতে পারে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সম্পূর্ণ সরকারি স্কেলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অতীতে মুদ্রাস্ফীতি বেতন বৃদ্ধির প্রকৃত সুফল খেয়ে ফেলেছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সমন্বয় না হলে নতুন স্কেল প্রতীকী হয়ে থাকতে পারে। কমিশন সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন অনুপাত ১৫:১ থেকে কমিয়ে ১২:১ করার প্রস্তাব দিলেও শিক্ষকরা আরও শক্তিশালী বেতন কাঠামোর দাবি জানাচ্ছেন।
 
কম বেতন শুধু শিক্ষা নয়, অর্থনীতি ও সমতা—তিন ক্ষেত্রেই বিপর্যয় ডেকে আনছে। মাঠ পর্যায়ের রিপোর্ট অনুযায়ী যে কোনো দিনে বহু প্রাথমিক শিক্ষক অনুপস্থিত থাকেন। পারিবারিক জীবিকা টিকিয়ে রাখতে অনেকেই অতিরিক্ত আয়ের জন্য কোচিং ও টিউশনিতে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে শ্রেণিকক্ষে সময় ও মনোযোগ কমে যায়। ২০২৪ সালের এএসইআর রিপোর্টে দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণির বই পড়তে পারে না। যা সরাসরি শিক্ষক সংকট, অনুপ্রেরণা ও সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, শিক্ষক বেতন ১০ শতাংশ বাড়ালে শিক্ষার্থীদের শেখার সক্ষমতা ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং জাতীয়ভাবে এটি দীর্ঘমেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বছরে ০.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। নারী শিক্ষকদের ৬০ শতাংশ উপস্থিতি থাকলেও কম বেতনের কারণে তাদের পদত্যাগের হার পুরুষদের দ্বিগুণ, ফলে এসটিইএম খাতে নারী শিক্ষকের ঘাটতি বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো দক্ষ শিক্ষক হারিয়ে শহরমুখী হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাখাতে জিডিপির মাত্র ১.৫৩ শতাংশ ব্যয় করে। এটি এসডিজির লক্ষ্যের অর্ধেক। পুরো শিক্ষাবাজেটের ৭০ শতাংশ শিক্ষক বেতনে গেলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এর ফল সবচেয়ে কম।
 
এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষকদের অন্য পেশার সাথে তুলনা করা যায় না। তারা জাতি গঠনের কারিগর। তাদের মর্যাদা ও বেতন কাঠামোকে সে অনুযায়ী মূল্যায়ন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষক মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা পান, যা দিয়ে পরিবার চালানো অসম্ভব। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে কোচিং বা টিউশনি করেন, যা তাদের মানসিক চাপ বাড়ায় এবং শ্রেণিকক্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’
তিনি আরও করেন, ‘যদি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও জীবন-ধারণযোগ্য বেতন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি বদলে যাবে। বর্তমান বাজারদর বিবেচনায় শিক্ষকদের বেতন অন্তত দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানো প্রয়োজন।” তার মতে, “শিক্ষকদের ১৬তম গ্রেডে রাখা অবিচার। তাদের মর্যাদা আলাদা করে নির্ধারণ করা উচিত।’
সময় থাকতেই ব্যবস্থা না নিলে দেশে দুই শ্রেণির শিক্ষা ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে; যেখানে ধনী পরিবারের শিশুরা ভালো শিক্ষা পাবে, আর বাকিরা থেকে যাবে নিম্নমানের শিক্ষায় এমন সতর্ক করেছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, আজকের শ্রেণিকক্ষ আগামী দিনের কর্মশালা, সংসদ ও রাষ্ট্রনির্মাণের কেন্দ্র। শিক্ষককে ক্লার্কের মতো বেতন দিলে দেশও ক্লার্কের মতোই চিন্তা করবে।
 
       
                 
                
 
                                                  
                                                  
                                                  
                                                  
                                                 