Image description

প্রচণ্ড তাপজনিত কারণে শ্রম উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় গত বছর দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার (২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বেড়েছে গরমজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৯৫১ থেকে ১৯৬০—এই ১০ বছরের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৪—এই ১০ বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়েছে ৯০ শতাংশ।

‘দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের এমন চিত্র উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সি৩ইআর) এবং দ্য ল্যানসেট কাউন্টডাউন গ্লোবাল টিম যৌথভাবে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সহযোগিতা করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিট।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ও গ্রিনথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ড. সৌর দাশগুপ্ত। বার্ষিক এই আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বিশ্বের ৫০টির বেশি সূচক বিশ্লেষণ করা হয়, যেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, খরা, রোগের প্রাদুর্ভাব এবং কৃষি ও শ্রমক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতির তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বায়ুদূষণকে এখনো অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০২২ সালে মানবসৃষ্ট বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে দুই লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা ২০১০ সালের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে মোট বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর ৪১.৫ শতাংশ‌ই (৩০,৬০০ জন) হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ৩২ শতাংশ‌ই ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা পোড়ানো।

ঘরের ভেতর বায়ুদূষণে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৭৪ জন মারা যায়, যা নারী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তাপপ্রবাহের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। গত বছর দেশে গড়ে প্রত্যেক ব্যক্তি ২৮.৮ দিন করে তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে ১৩.২ দিন কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটেছে। সেই সঙ্গে ১৯৫১ থেকে ১৯৬০—এই ১০ বছরের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৪—এই ১০ বছরে সংক্রমণের উপযোগী আবহাওয়া বেড়েছে ৯০ শতাংশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো স্পষ্ট করে তুলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশক থেকে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব দ্রুত বেড়েছে। তাপজনিত কারণে ২০২৪ সালে দুই হাজার ৯০০ কোটি (২৯ বিলিয়ন) সম্ভাব্য কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়েছে, যা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেশি। এই ক্ষতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কৃষি খাতে। মোট ক্ষতি হওয়া সময়ের ৬৪ শতাংশই কৃষি খাতের শ্রমিকদের। এর ফলে বাংলাদেশের সম্ভব্য মোট আয় কমেছে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা (২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ এবং কৃষি খাতের আয়ের ৫৫ শতাংশের সমান।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার এখনো মাত্র ০.৮৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকির পেছনে, যা কার্বন ট্যাক্স বা নিঃসরণ হ্রাস থেকে অর্জিত যেকোনো লাভের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব পড়ছে। গত এক হাজার বছর ধরে যা হয়নি, তা আগামী ৩০ বছরে ঘটবে।’

আইনুল নিশাত বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয়দের কাছ থেকে আমি শুনেছি, লবণাক্ততা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় পান করার মতো পানি নেই। পরিবারগুলো ছাদে বৃষ্টির পানি জমাতে তিন থেকে চার হাজার লিটার ধারণক্ষম ট্যাংক কিনছে। এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব ভয়াবহ। ল্যানসেট কাউন্টডাউন প্রতিবেদন জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর স্বাস্থ্যগত পরিণতি তুলে ধরেছে। এখন আমাদের গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে কাজ করতে হবে।’

ল্যানসেটের প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের লাখো মানুষের জীবন হুমকির মুখে। তাই এখনই সমন্বিত জাতীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘আমরা সাভারকে একটি নিয়ন্ত্রিত বায়ুমান অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছি, সেখানে কোনো ইট পোড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। তাপজনিত চাপ মোকাবেলায় আমরা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা মিশা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে স্বাস্থ্যকে একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে বক্তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও বায়ুর মান উন্নয়নে নীতিগত ও আর্থিক বিনিয়োগ বাড়াতে জোর দেন।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রাব্বী সাদেক আহমেদ, ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিক অ্যাডভাইজার ওয়াসিস পেরে প্রমুখ।