Image description

শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে চলতি বছরই অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে চলতি বছরের প্রাথমিক বৃত্তির বিষয়েও মন্ত্রণালয়ের নতুন সিদ্ধান্তে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ১৬ লাখ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শেষ সময়ে এসে সরকার জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রস্তুতির সময়স্বল্পতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নতুন চাপের মুখে পড়েছে। এছাড়া উভয় বৃত্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করবে।

এরই মধ্যে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নিতে নীতিমালা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের নীতিমালা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে। আগামী ২১ ডিসেম্বর জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হবে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রকাশিত জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে অধ্যয়নরত অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এ প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অন্যদিকে ১৭ জুলাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০২৫ সালের পঞ্চম শ্রেণির সরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে কেবল দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআইসংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিক্ষোভ-আন্দোলনের পরও সিদ্ধান্তে বদল না আসায় শেষ পর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। আদালত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ওপর দুই মাসের স্টে অর্ডার দিয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় আপিল করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

নাম ও পদবি উল্লেখ না করার শর্তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের বিপরীতে একটি রিট করেছিলেন বিক্ষুব্ধরা। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপনের ওপর দুই মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছে আদালত। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আপিল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

দেশের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। নতুন নীতিমালায় পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা নিলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১৬ লাখ শিক্ষার্থী এ থেকে বঞ্চিত হবে।

সংগঠনটির মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণির সরকারি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে না পারলে দেশের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থীর প্রতি অবিচার করা হবে। এর ফলে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এই শিশুরা রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হবে।

আরমানিটোলা স্কুলের শিক্ষার্থী আদি বলে, শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালু হওয়ায় আমাদের বাড়তি চাপে ফেলে দিয়েছে। কেননা, হাতে সময় মাত্র দুই মাস। এতে প্রস্তুতির সময় খুবই কম।

তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষাজীবনের শুরুতেই অগ্রসরমান সমাজের শিশুদের বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হচ্ছে। বিজ্ঞাপন দিয়ে বা বিভিন্ন কৌশলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজটি করছে। সমাজের অগ্রসর অংশের ওই শিশুরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়লেও তাদের ফলাফল ভালোই হতো। তিনি বলেন, অনগ্রসর শিশুদের সুযোগ সৃষ্টি করতেই এ নীতিমালা।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময়ই জানানো উচিত। কিন্তু শিক্ষাবর্ষের একেবারে শেষ সময়ে এসে এমন পরীক্ষার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে। আবার মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষায় বৈষম্য বাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের। এতে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের আরো পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ওই ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপরই মনোযোগ দেবে। ক্লাসের অন্যান্য নজরের বাইরে চলে যেতে পারে। অথচ শিক্ষাক্রম নির্ধারিত শিখন অর্জনের জন্য পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বেশি সহযোগিতা করা দরকার। এছাড়া কোচিং-প্রাইভেটনির্ভরতা বেড়ে গিয়ে অভিভাবকদের ওপর আর্থিক বোঝা বাড়ার আশঙ্কা আছে বলেও মনে করেন তারা।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, এখনো শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন সঠিক করা যায়নি। সেটি ঠিক না করে কোটাভিত্তিক বৃত্তি পরীক্ষা চালু হলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও বৈষম্য আরো বাড়বে। তার মতে, গরিব ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনা করে তাদের আরো কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বৃত্তি পরীক্ষায় যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, সেটিসহ আরো অর্থ মিড-ডে মিল ও উপবৃত্তি বাড়াতে ব্যয় করা উচিত।