
বাইরে থেকে পরিস্থিতি আঁচ করা কঠিন। তবে সিলেটের সাদাপাথর লুটের ঘটনায় প্রশাসনের ভেতরে যে কম্পন চলছে সেটি অনেকেই টের পাচ্ছেন। ডিসি মাহবুব মুরাদ প্রত্যাহার, ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলির ঘটনায় সিলেটে তোলপাড় চলছে। সাদাপাথর নিয়ে নেট দুনিয়া এখনো সরব। প্রশাসনের কর্মকাণ্ড নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই অবস্থায় সিলেটের ইউএনও পর্যায়ে যে রদবদল হয়েছিল সেখানেও ঘটেছে নাটকীয়তা। দায়িত্ব পালনে কোম্পানীগঞ্জে যেতে চান না ইউএনওরা। ‘বার্নিং ইস্যু’ সাদাপাথর থেকে তারা থাকতে চান দূরে। সোমবার সিলেটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে যখন প্রত্যাহার করা হয় ঠিক তখনই কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হয়। তার নতুন ঠিকানা একই জেলার আরেক উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জ। আর ফেঞ্চুগঞ্জের ইউএনও শফিকুল ইসলামকে বদলি করা হয় কোম্পানীগঞ্জে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- ইউএনও শফিকুল ইসলাম কোম্পানীগঞ্জ যেতে চাননি। এ জন্য তিনি তদবির শুরু করেন। তদবিরে কাজ হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জের পরিবর্তে তাকে চুনারুঘাটে বদলি করা হয়। সেখানে নতুন ইউএনও হিসেবে বদলি হয়েছেন মোহাম্মদ রবিন মিয়া। তারা জানিয়েছেন- ইউএনও রবিনও কোম্পানীগঞ্জে বদলি হতে রাজি ছিলেন না। তবে প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালনে অবশেষে তিনি সেখানে গিয়ে যোগদান করছেন। অথচ নিকট অতীতে কোম্পানীগঞ্জে বদলি হতে কোনো কর্মকর্তাই ‘না’ সূচক মনোভাব দেখাননি। অতীতে পাথর লুটের ঘটনায় ওসি কিংবা পুলিশের কর্মকর্তারা বিতর্কিত হয়ে শাস্তিমূলক প্রত্যাহার হলেও প্রশাসনের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তার গায়ে আঁচড় লাগেনি। বরং প্রশাসন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিতর্কহীনভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও নিয়ে কেন এই নাটকীয়তা? এ প্রশ্নের জবাবও সহজ। বদলি হওয়া ইউএনও আজিজুন্নাহারই সব নাটকীয়তার উৎস। তিনি ৭ মাস দায়িত্ব পালন করেছেন কোম্পানীগঞ্জে। এই সময়েই সিলেটের পাথররাজ্য বলে খ্যাত ভোলাগঞ্জ কোয়ারি, সাদাপাথর, শারপিন টিলার পাথর হরিলুট হয়েছে। এমনকি ইউএনও পরিদর্শনের সময় চোখের সামনে হয়েছে পাথর লুট। বালু লুটপাটেও ব্যর্থতা ছিল তার। তবে কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করতেন তিনি। এ নিয়ে ছিল নানা রহস্য।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সহ সুশীল সমাজের লোকজন জানিয়েছেন- কোম্পানীগঞ্জ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ছিলেন ইউএনও আজিজুন্নাহারের টাকার উৎস। তারা ভোলাগঞ্জ কোয়ারি, ক্রাশার মিল ও বালু লুট থেকে টাকা আদায় করতেন। আর ওই টাকার একাংশে ভাগ যেতো ইউএনও’র কাছে। তবে বেশির ভাগ টাকা থানার ওসি’র মারফতে তার কাছে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন তারা। বলেন- বালুঘাট থেকে প্রতিদিন ওসি’র নামে দুই লাখ ও ইউএনও’র নামে এক লাখ টাকা আসতো। এই বিষয়টি অনেকটা প্রকাশ্যেই ছিল। এ ছাড়া, ইউএনও’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের রয়্যালিটি ঘাট ও গাড়ি পার্কিং এলাকা। প্রায় তিন বছর আগে প্রশাসনের তরফ থেকে ইজারার মাধ্যমে ওই ঘাট ব্যক্তি পর্যায়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ইজারা নিয়ে বিরোধের জেরটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলায় গড়ায়। ইজারা প্রদানের বিষয়টি উচ্চ আদালতের নির্দেশেই বন্ধ ছিল। আর এই সুযোগে খাস কালেকশনের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্মকর্তারা এটি নিয়ন্ত্রণ করতেন।
অভিযোগ আছে; এই ঘাটে রয়্যালিটি বাবদ যে টাকা আদায় হতো এর অর্ধেকও সরকারি কোষাগারে জমা হতো না। এক-তৃতীয়াংশ টাকা সরকারি কোষাগারে যেতো বাকি টাকা ইউএনও সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা লুটপাট করেছেন। গত ৭ মাসে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ প্রশাসনের কয়েকজন কর্মচারী এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানান, গত রমজানের ঈদের টানা ৬ দিন সরকারি ছুটি থাকায় লাখ লাখ পর্যটকের ঢল নেমেছিল সাদাপাথরে। ওই ৬ দিনে রয়্যালিটি বাবদ আদায় করা হয়েছিল ৩২ লাখ টাকা। কিন্তু সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে ১১ লাখ টাকা। বিষয়টি নিয়ে কোম্পানীগঞ্জ প্রশাসনের ভেতরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিন ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা রয়্যালিটি বাবদ আদায় করা হলে জমা পড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। বাকি টাকা ইউএনও সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা পকেটস্থ করেন। সাদাপাথরের পিকনিক স্পটের টাকা লুটপাটের বিষয়টি ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওখানকার ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন- পর্যটন স্পটের রয়্যালিটির টাকা কমই জমা হয় সরকারি কোষাগারে। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রমাণাদি তারা সংগ্রহ করে রেখেছেন। গত এক মাস আগে উচ্চ আদালত থেকে ইজারা স্থগিতের আদেশটি প্রত্যাহার করা হলেও ইউএনও লাভের এই খাত নিজ হাত থেকে ছেড়ে দিতে নতুন করে ইজারা প্রদানের দরপত্র আহ্বান করেননি। রয়্যালিটি আদায়ে নিয়োজিত থাকা ইউএনও ও এসিল্যান্ড কার্যালয়ের কর্মচারীরা জানিয়েছেন- পিকনিক স্পটে যে টাকা রয়্যালিটি আদায় করা হতো সেগুলো রিসিট বই সহকারে তারা এনে ইউএনও’র নাজির মিজানুর রহমানের কাছে জমা দিতেন। এরপর কী হতো সে ব্যাপারে তারা খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টাও করেননি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে বিদায়ী ইউএনও আজিজুন্নাহারকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। ইউএনও নাজির মিজানুর রহমানকে পিকনিক স্পটের রয়্যালিটি আদায় প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করতেই উত্তরে বলেন; ‘ওই স্পটের রয়্যালিটি নিয়ে আমি কিছু জানি না। সব জানেন বিদায়ী ইউএনও স্যার।’ কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিকরা জানিয়েছেন- ইউএনও আজিজুন্নাহার কার্যত কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক সহ সুশীল সমাজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল পাথর ও বালুখেকোদের। কয়েক মাস বিদেশি একটি সংস্থার অর্থায়নে সিলেট ও কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিকরা বাল্যবিয়ে নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। সেই সেমিনারের জন্য উপজেলার হলরুম চাওয়া হলে ইউএনও সেটি বরাদ্দ দেননি। বরং ওই সেমিনার নিয়ে অযাচিত কিছু মন্তব্যও করেন। তারা জানান, সাদাপাথর, শারপিন টিলা, কালাইরাগ ও উৎমা এলাকায় পাথর লুটের সময় একাধিকবার ইউএনওকে ফোন দিয়ে আইনি সহযোগিতা চাওয়া হলেও তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেন। মাঝেমধ্যে নামমাত্র অভিযানে যেতেন। তবে অভিযানে যেসব নৌকা ও শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল-জরিমানা করা হতো সেখানেও পরবর্তীতে টাকার খেলা হতো। উপজেলা নাজির মিজানুর রহমান এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন বলে জানান তারা। তবে ইউএনও অভিযানিক ব্যর্থতার দায় মানতে নারাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কেউ কেউ। তারা বলেন, ইউএনও পাথর ও বালু লুট বন্ধ করতে যখনই অভিযানের প্রস্তুতি নিতেন তখনই তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতেন কোম্পানীগঞ্জের ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান। মাঝেমধ্যে বিজিবিও তার আহ্বানে সাড়া দিতো না। ওসি লোকবল সংকটের দোহাই দিয়ে অভিযানে পুলিশ দিতেন না। আর বিজিবি’র সিও পর্যায় থেকে প্রতিটি অভিযানের সময় ফোর্স চাওয়ার বিষয়টি সহজ না হওয়ায় সব সময় অভিযান পরিচালনা সম্ভব হতো না।