
গণপিটুনির পর রংপুরের তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট স্কুল মাঠে রুপলাল ও প্রদীপকে যখন নিয়ে আসা হয়, তখন খবর পেয়ে পুলিশের দুটি ভ্যান সেখানে আসে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাদের উদ্ধার করতে গেলে ‘মবের ভয়ে’ উদ্ধার না করে ফিরে যায় পুলিশ। ‘মবের ভয়ের’ বিষয়টি স্বীকার করেছে পুলিশ। অন্যদিকে সয়ার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ জানান, পুলিশ যখন সেখান থেকে ফিরে আসে তখনও তারা জীবিত ছিলেন।
এরপর প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি সেখানে আসে। এসময় তাদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে একজন হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান, অন্যজন কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ঘটনাস্থল বটতলা ও বুড়িররহাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ির পুরুষরা আত্মগোপনে রয়েছেন। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। স্থানীয় দু’একজনের দেখা মিললেও কেউ কোনো কথা বলতে চাচ্ছিলেন না।
বটতলা এলাকার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘কী আর কমো বাহে, কায় শোনে কার কথা! রাত ৯টার পর খবর ছড়িয়ে পড়ে, অজ্ঞান করে ভ্যান ছিনতাই করতে গিয়ে চোর ধরা পড়েছে। গিয়ে দেখি, হাজারো মানুষের ভিড়। সেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ থাকলেও কেউ কারো কথা শুনছিল না। যাদের মারধর করা হচ্ছিল তারা হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইলেও কারো মন গলেনি। উত্তেজিত লোকজন বটতলা থেকে মারতে মারতে তাদের বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়লে সেখানে তাদের ফেলে রাখা হয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুড়িরহাট এলাকার দুজন যুবক বলেন, এলাকায় শিশু হত্যা করে ভ্যান চুরিসহ চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ লোকজন সত্যি সত্যি তাদের ভ্যান চোর মনে করেছিল। সে কারণে তাদের কোনো আকুতিই শুনতে চায়নি তারা। শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেললো তাদের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানদার খোকন মিয়া বলেন, ‘ঘটনার সময় পুলিশের গাড়ি এসেছিল। কিন্তু অনেক লোক দেখে তারা ফেরত যায়।’
এ ব্যাপারে তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক বলেন, ‘থানা থেকে ঘটনাস্থল বেশ দূরের। যখন মব তৈরি হয়, তখন স্কুল মাঠে তিন চার হাজার লোক ছিল। পুলিশ ওই দুজনকে রক্ষার চেষ্টা করছিল। কিন্তু লোকজন সরছিল না। উত্তেজিত এতো মানুষ ডিঙিয়ে ওদের ওইভাবে সেফ করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।’
তিনি জানান, তথ্যপ্রযুক্তি, ভিডিও বিশ্লেষণ ও স্থানীয় লোকজনের দেওয়া তথ্য মিলিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সয়ার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ বলেন, ‘প্রথমে পুলিশ ঘটনাস্থলেই ছিল। কিন্তু গণপিটুনির শিকার দুজনকে উদ্ধার না করে ভয়ে ফিরে যায় তারা। ঘণ্টাখানেক পরে সেনাবাহিনীসহ আবার তারা এসে ওই দুইজনকে উদ্ধার করে। তখন উদ্ধার করলে হয়তো রুপলাল ও প্রদীপকে বাঁচানো যেতো।’
তিনি জানান, সম্প্রতি শিশু ইরফান বাবুকে গলা কেটে হত্যার পর ভ্যান চুরি করে নিয়ে যায় চোরেরা। এর আগেও আশপাশের এলাকায় তিনটি চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তখন থেকে এলাকা উত্তপ্ত ছিল। চোর ধরা পড়েছে, এমন খবর শুনে ক্ষুব্ধ লোকজন ছুটে গিয়ে শনিবার রাতে পিটিয়ে হত্যা করে তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই (মুচির কাজ) করে জীবিকা নির্বাহ করা ঘনিরামপুর গ্রামের রুপলাল দাস (৪০) ও তার ভাগনি জামাই প্রতিবন্ধী ভ্যানচালক মিঠাপুকুরের বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ লালকে (৩৫)।
যখন উত্তেজিত জনতা মারধর করছিল তখন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন রুপলাল দাস ও প্রদীপ লাল। হাতজোড় করে ভিড়ের মধ্যে তারা বলেছিলেন, ‘আমি চোর না, ডাকাত না।’ তবুও শেষরক্ষা হয়নি তাদের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মর্মস্পর্শী আকুতির সেই ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বটতলা এলাকায় ভ্যান থামিয়ে রুপলাল ও প্রদীপকে আটক করেন। ভ্যান থেকে বের করা হয় একটি প্লাস্টিকের বস্তা। নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা চুপ ছিলেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন তাদের মারতে যান। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ তাদের মারধর করতে বাধা দেন এবং পুলিশে খবর দেওয়ার কথা জানান।
এসময় রুপলাল উত্তর দেন ‘আমি চোর না-ডাকাতও না, মুচি। তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করি।’ কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন উচ্চস্বরে বলে ওঠে ‘তুই চোর-ডাকাইতের বাপ।’ আর ভ্যানের ওপরে বসা প্রদীপকে লক্ষ্য করে লোকজন বলতে থাকেন ‘মাল খেয়ে আসছে, অভিনয় করছে।’
এসময় ভ্যানে থাকা বস্তায় প্লাস্টিকের বোতল বের করে নাকে নিয়ে গন্ধ শুঁকেন মেহেদী হাসান নামের এক যুবক। কিছুক্ষণ পরই তিনি বলেন, ‘এ ভাই, দয়া করে আমাকে ধরো’ বলে মাটিতে পড়ে যান। দু’জন তাকে ধরে সরিয়ে নেন। তখনই ক্ষুব্ধ জনতা রুপলাল ও প্রদীপকে মারধর শুরু করে।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
নিহতের পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রুপলাল দাসের মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। গত রোববার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য আগের দিন শনিবার মিঠাপুকুরের বালুয়াভাটা থেকে ভাগনি জামাই প্রদীপ লালকে ডেকে আনা হয়। নিজের ভ্যান চালিয়ে প্রতিবন্ধী প্রদীপ লাল তারাগঞ্জের রুপলাল দাসের বাড়ির দিকে রওনা হন। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন। সেখানে রুপলাল গিয়ে দু’জনে ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে আসছিলেন।
রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দু’জনকে থামান স্থানীয় কয়েকজন। এর পর সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে প্রদীপ লালের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন লোকজন। এর একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে অসুস্থ হয়ে পড়েন পাশারিপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক আলমগীর হোসেন ও বুড়িরহাটের মেহেদী হাসান। এতে লোকজনের সন্দেহ আরও বাড়ে। এরপর ভ্যান চুরির সন্দেহে তাদের মারধর শুরু করেন লোকজন।
মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তাদের ফেলে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রোববার ভোরে তিনিও মারা যান।
রুপলালের ছেলে জয় দাস বলেন, ‘বিনা অপরাধে আমার বাবা-দাদাকে মেরে ফেলেছে ওরা। ভিডিও দেখেছি, দুই হাত জোড় করে বাবা প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা কোনো কথাই শোনেনি।’
রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই (মুচির কাজ) করে বৃদ্ধা মাসহ স্বামী-স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলতো রুপলাল দাসের সংসার। কিছু টাকা জমিয়েছিলেন বড় মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ে দেবেন বলে। বিয়ের কথাবার্তাও চলছিল। দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য মিঠাপুকুরের বালুয়াভাটা গ্রাম থেকে নিজে ভ্যান চালিয়ে বাড়িতে আসছিলেন ভাগনি জামাই প্রদীপ লাল। কিন্তু পথে ভ্যান চোর সন্দেহে এলাকার লোকজন গণপিটুনিতে মেরে ফেলেন দুজনকেই। ছয় সদস্যের একমাত্র উপার্জনক্ষম রুপলাল দাসের মৃত্যুতে মেয়ের বিয়েসহ সব স্বপ্ন যেন মাটিতে মিশে যায়।
অন্যদিকে, প্রদীপ লাল নিজের বসতভিটা না থাকায় অন্যের জমিতে বানানো দুই কক্ষের ঘরে স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার করতেন। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা হারান পাঁচ বছর আগে। তবু হাল ছাড়েননি। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন হাতে অল্প কিছু টাকা নিয়ে ক্লান্ত শরীরে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘরে ফিরতেন।
প্রদীপের ছেলে দুলাল কুমার বলেন, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মোবাইল ফোনে বাবা প্রদীপ লালের কথা হয়। পরে রাত সাড়ে ৯টায় বাবাকে ফোন দিলে তার ফোন বন্ধ পাই। পরে সেখানে তিনি আছেন এমন খবর পেয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার ভোরে আমার বাবা মারা যান।
গণপিটুনিতে দু’জনকে হত্যার ঘটনায় নিহত রুপলালের স্ত্রী ভারতী দাস বাদী হয়ে রোববার দুপুরে তারাগঞ্জ থানায় ৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। এরপর অভিযান চালিয়ে রোববার রাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।