Image description

দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি থেকে শুরু করে পরিশোধন ও গ্রাহকপর্যায়ে বিপণন নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তিন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে এসব জ্বালানি বিপণন করে সংস্থাটি।

নির্ধারিত পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রির বিপরীতে বিপিসি থেকে লিটারপ্রতি নির্ধারিত হারে কমিশন পায় বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান তিনটি। বিপিসি থেকে বাকিতে পায় তারা। বাকিতে কিনে নগদে বিক্রি করে। তবে তেল বিক্রির চেয়ে গত পাঁচ বছরে নন-অপারেশনাল খাত থেকে বেশি আয় করেছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা।

নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে তিন কোম্পানির (কর পরবর্তী) নিট লাভ চার হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অপারেশনাল প্রফিট এক হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। অবশিষ্ট আয় এসেছে ব্যাংক সুদ থেকে। অভিযোগ আছে, বিপিসির বকেয়া নিয়মিত পরিশোধ না করে জমিয়ে রাখা টাকা ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে মূল ব্যবসার বাইরে ব্যাংক সুদে বেশি লাভবান হচ্ছে অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তিনটির।

 

বাকিতে কিনে নগদে বিক্রি

তিন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি বিপিসি থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য পেয়ে তা বিপণন করে। তারা পণ্য হিসেবে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল, মেরিন ফুয়েল, জেট ফুয়েল সরাসরি বিপিসি থেকে পায়। মূলত পেট্রোলিয়াম পণ্য কেনায় বিপণন কোম্পানি তিনটিকে আগাম কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না বিপিসিকে। তবে নিজেদের ডিলার ও এজেন্টদের কাছ থেকে আগাম পে-অর্ডার নিয়ে এসব পণ্য বিক্রি করে কোম্পানি তিনটি।

নির্ধারিত পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রির বিপরীতে বিপিসি থেকে লিটারপ্রতি নির্ধারিত হারে কমিশন পায় বিপণন প্রতিষ্ঠান তিনটি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সবশেষ গত ২১ আগস্ট তারিখের গেজেট অনুযায়ী বর্তমানে লিটারপ্রতি ডিজেলে ৭০ পয়সা, কেরোসিনে ৮০ পয়সা এবং অকটেন-পেট্রোলে ৯০ পয়সা করে মার্জিন পাচ্ছে বিপিসির বিপণন কোম্পানিগুলো। এর আগে ডিজেল-কেরোসিনে লিটারপ্রতি ৫০ পয়সা করে ও পেট্রোল-অকটেনে লিটারপ্রতি ৬০ পয়সা করে মার্জিন (কমিশন) পেতো বিপণন কোম্পানিগুলো।

 

বিপিসির বকেয়া টাকা এফডিআর হিসেবে মেঘনা পেট্রোলিয়াম অধিকতর আয় করেনি। কোম্পানির ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সাধারণ সংরক্ষিত তহবিল খাতে জমার পরিমাণ ১৮শ ৪০ কোটি টাকা এবং অবণ্টিত মুনাফার পরিমাণ ৫৪১ কোটি ৯৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৩ টাকা, যা কোম্পানির এফডিআরে বিনিয়োগ করে আয় করে।- মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বোর্ড চেয়ারম্যান ফারজানা মমতাজ

কার কাছে নগদ ও ব্যাংক জমা কত টাকা

২০২৩-২৪ অর্থবছরের তিন কোম্পানির বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ জুন বিভিন্ন ব্যাংকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ডিপোজিটসহ তিন কোম্পানির নগদ ও ব্যাংক স্থিতি ছিল ১৭ হাজার ৩৪ কোটি ৫৯ হাজার ৩৪০ টাকা। এর মধ্যে পদ্মা অয়েলের নগদ ও ব্যাংকে জমা ছিল ৫ হাজার ৪৯০ কোটি ৬৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের নগদ ও ব্যাংকে জমা ছিল ৫ হাজার ৪৭৭ কোটি ১৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫ টাকা এবং যমুনা অয়েলের নগদ ও ব্যাংকে জমা ছিল ৬ হাজার ৬৬ কোটি ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ২৮৫ টাকা।

তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপিসির পাওনা

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসির নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৩০ জুন তিন কোম্পানি থেকে বিপিসির পাওনা ছিল ২৪ হাজার ৫৭৯ কোটি ৬৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪২১ টাকা। এর মধ্যে পদ্মা অয়েল থেকে ৯ হাজার ৩৬৯ কোটি ৫৮ লাখ ২৯ হাজার ৯৬৪ টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়াম থেকে ৭ হাজার ২৩৩ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৩৬৫ টাকা এবং যমুনা অয়েল থেকে ৭ হাজার ৯৭৬ কোটি ৯৭ লাখ ১৭ হাজার ৯২ টাকা বিপিসির পাওনা ছিল।

কার কত লাভ?

পদ্মা অয়েল কোম্পানির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই অর্থবছর পদ্মা অয়েলের অপারেটিং মুনাফা হয়েছে ১৪৫ কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ওই বছর এফডিআরসহ ব্যাংক জমার ইন্টারেস্ট খাতে নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই অর্থবছর পদ্মা অয়েল কর পরিশোধ পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ৪০৮ কোটি ৫৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

একইভাবে পদ্মা অয়েল কোম্পানি ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে অপারেটিং প্রফিট করেছে মাত্র ৪৩৪ কোটি ২৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। একই সময়ে পদ্মা অয়েলের নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ১৫৬৮ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক সুদ হচ্ছে ১৫৩৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা। পদ্মা অয়েল কোম্পানি ৫ বছরে নিট প্রফিট (কর পরবর্তী) করেছে ১৫শ কোটি ৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর জ্বালানি তেল সরবরাহ সিস্টেম অটোমেশন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমও অটোমেশন প্রক্রিয়ায় আনা হচ্ছে। তাতে বিপিসির বকেয়া টাকা দীর্ঘদিন ধরে রাখার বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে।- জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম

একইভাবে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই বছরে তাদের অপারেটিং মুনাফা হয়েছে ১৫৮ কোটি ৭৪ লাখ ৯৯ হাজার ৭৬৪ টাকা। ওই বছরে কোম্পানিটিতে এফডিআরসহ ব্যাংক জমার ইন্টারেস্ট খাতে নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ৫২৭ কোটি ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৫৫ টাকা। একই অর্থবছর মেঘনা পেট্রোলিয়াম কর পরিশোধ পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ৫৪২ কোটি ২৯ লাখ ৭২ হাজার ৯৫৪ টাকা।

২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম পাঁচ বছরে অপারেটিং প্রফিট করেছে মাত্র ৬৭৯ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার ১৩ টাকা। একই সময়ে কোম্পানির নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ১৮৯২ কোটি ৮১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫৩ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক সুদ হিসেবে আয় হয়েছে ১৭শ ৭১ কোটি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫২২ টাকা। মেঘনা পেট্রোলিয়াম পাঁচ বছরে নিট প্রফিট (কর পরবর্তী) করেছে ১৮শ ৯১ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ৮০ টাকা।

পদ্মা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মতোই অপারেটিং মুনাফার চেয়ে ব্যাংক সুদে আয় বেশি করেছে যমুনা অয়েল কোম্পানিও। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যমুনা অয়েলের বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই অর্থবছর যমুনা অয়েল অপারেটিং মুনাফা করেছে মাত্র ৪৫ কোটি ৪১ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৪ টাকা। ওই বছর এফডিআরসহ ব্যাংক ইন্টারেস্ট হিসেবে আয় হয়েছে ৫১৯ কোটি ৫৫ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫৬ টাকা। এতে কোম্পানিটি কর পরিশোধ পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ৪৪১ কোটি ৬৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪২৫ টাকা।

২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি পাঁচ বছরে অপারেটিং প্রফিট করেছে মাত্র ১৮৫ কোটি ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৪৮ টাকা। একই সময়ে কোম্পানির নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ১৭শ ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ ২৩ হাজার ২৭৯ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক সুদ হিসেবেই আয় হয়েছে ১৫শ ৫১ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৮ টাকা। যমুনা অয়েল ওই পাঁচ বছরে নিট প্রফিট (কর পরবর্তী) করেছে ১৩শ ৭০ কোটি ৪৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪০ টাকা।

বিপিসির অর্থ পরিশোধ না করে এসব টাকা এফডিআর হিসেবে বিনিয়োগ করে ব্যাংক সুদ হিসেবে নন অপারেশনাল খাতে আয় করছে তিন প্রতিষ্ঠান। ওই খাত থেকে ডব্লিউপিপিএফ ৫ শতাংশ দেওয়া হচ্ছে। তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? জাগো নিউজের পক্ষ থেকে পদ্মা অয়েল কোম্পানির চেয়ারম্যান সাবেক সচিব এ কে এম জাফর উল্লা খান, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ এবং যমুনা অয়েলের চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়।

মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বোর্ড চেয়ারম্যান ফারজানা মমতাজ ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্যে জাগো নিউজকে জানান, ‘বিপিসির বকেয়া টাকা এফডিআর হিসেবে মেঘনা পেট্রোলিয়াম অধিকতর আয় করেনি। কোম্পানির ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সাধারণ সংরক্ষিত তহবিল খাতে জমার পরিমাণ ১৮শ ৪০ কোটি টাকা এবং অবণ্টিত মুনাফার পরিমাণ ৫৪১ কোটি ৯৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৩ টাকা, যা কোম্পানির এফডিআরে বিনিয়োগ করে আয় করে।’

বাকি দুজন কোনো বক্তব্য দেননি।

এ বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর জ্বালানি তেল সরবরাহ সিস্টেম অটোমেশন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমও অটোমেশন প্রক্রিয়ায় আনা হচ্ছে। তাতে বিপিসির বকেয়া টাকা দীর্ঘদিন ধরে রাখার বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে।’