
গাজীপুরে একটি চক্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও এতিমখানার নামে বরাদ্দ জিআর চাল হাতিয়ে নিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরাদ্দকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেকটা বাধ্য হয়েই ওই চক্রের কাছে এসব চাল ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকারি নিয়মে চাল বিতরণ করার কথা থাকলেও গাজীপুর জেলা এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে জেলার প্রতিটি অফিসেই একটি করে শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। বরাদ্দে বেশি চাল দেওয়ার জন্য তারা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে এতিমের ভুয়া সংখ্যা দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করছেন।
শ্রীপুর উপজেলার তৎসময়ের পিআইও শফিকুল ইসলাম, অফিস সহকারী মিজানুর রহমান, বাচ্চু মিয়া এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আওলাদ হোসেনের বিরুদ্ধে এভাবে অর্থ আত্মসাতে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
গত ঈদুল আজহার আগে শ্রীপুর উপজেলার ৮৩টি মাদ্রাসা ও এতিমখানার (লিল্লাহ বোর্ডিং) শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য ১৬৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ (জিআর) দেয় জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা।
অভিযোগ রয়েছে, বরাদ্দকৃত প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নামমাত্র কিছু টাকা দিয়ে একটি চক্রের সহায়তায় ১৬৬ টন চালের প্রায় সব বিক্রি করা হয়েছে। বাকি সব টাকাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন।
গত ৪ মে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন স্বাক্ষরিত বরাদ্দ তালিকায় শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া বাজার মারকাজুল কুরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানার নাম রয়েছে ৩৮ নম্বর ক্রমিকে। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুনের আগে ওই চাল তুলে নিয়েছেন মাদ্রাসার মুহতামিম।
সরেজমিন ওই মাদ্রাসায় গেলে মুহতামিম হাফেজ মাওলানা মাহবুবুর রহমান জানান, তিন মাস ধরে তিনি দায়িত্বে আছেন। সরকারি চাল বরাদ্দের বিষয়ে কিছুই জানেন না। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি, ক্যাশিয়ার বা অন্য সদস্যরাও কিছু জানেন না। তারা অনেক কষ্টে কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানা পরিচালনা করেন। সরকার ২ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। ওই চাল পেলে লিল্লাহ বোর্ডিং চালানো সহজ হতো। যারা চাল তুলে আত্মসাৎ করেছে তাদের বিচার দাবি করেন তিনি।
মাদ্রাসার সভাপতি এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি ইসলাম উদ্দিন মন্ডল বলেন, কয়েক মাস আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছিলাম। বরাদ্দ এসেছে কেউ জানায়নি। হতদরিদ্র এতিমদের খাবারের ওই চাল কাদের পকেটে ঢুকেছে প্রশাসনের কাছে তার জবাব চাইব।
বরাদ্দ তালিকায় ৬১ নম্বর ক্রমিকে থাকা সাতখামাইর উত্তরপাড়া নূরানী মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য বরাদ্দ ছিল ২ মেট্রিক টন চাল।
প্রতিষ্ঠানের মুহতামিম মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, গত ঈদুল আজহার আগে এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কল দিয়ে জানান, আপনাদের মাদ্রাসার জন্য ২ টন চাল বরাদ্দ হয়েছিল। এক মেট্রিক টন স্যারেরা খেয়ে ফেলেছে। আর এক মেট্রিক টনের দাম বাবদ ২০ হাজার টাকা রাখা আছে। বরাদ্দ উত্তোলনের আবেদনপত্র, এনআইডি কার্ড ও এক কপি ছবি নিয়ে এসে টাকা নিয়ে যান।
তিনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে গেলে অফিস সহকারী মিজানুর রহমান বরাদ্দ উত্তোলনের আবেদনপত্র, এনআইডি কার্ড ও ছবি রেখে উপজেলা পরিষদের বাইরে একটি মসজিদে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন।
কিছুক্ষণ পর এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে ডিওতে স্বাক্ষর নিয়ে ২০ হাজার টাকা দেন। এসব নিয়ে মুখ খুললে ভবিষ্যতে আর চাল বরাদ্দ দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেন অজ্ঞাতপরিচয় ওই ব্যক্তি।
সরেজমিন গিয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই-একটি ছাড়া প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ থেকে এক টন স্যারদের কথা বলে বাদ দিয়ে এক টনের দাম দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে সরকার এক মেট্রিক টন চালের দাম ৫৬ হাজার ৩৮২ টাকা নির্ধারণ করলেও মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর প্রকল্প সভাপতিদের দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা করে। বাকি টাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও তার দপ্তরের কর্মচারী এবং খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
নিমুরিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, রমজান মাসে আবেদন করেছিলাম। বরাদ্দ হয়েছিল ২ টন চাল। কুরবানির ঈদের আগে ফোন পেয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে গিয়ে দেখা করি। তিন দিন ঘোরাঘুরির পর ২ টন চালের দাম হিসেবে ওই অফিসের কর্মচারী বাচ্চু আমাকে ২৫ হাজার টাকা দেন। দুই টন চালের বাজারমূল্য কত তা আপনারা জানেন, আমি জানি না। ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাত্রদের খাবারের জন্য কিছু চাল কিনে বাকি টাকা দিয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানার মেরামত কাজ করা হয়েছে। এতিমখানার জন্য প্রতিদিন ১২-১৩ কেজি চাল লাগে। টাকার পরিবর্তে চাল পেলে উপকার বেশি হতো।
উপজেলার চরদমদমা দারুল উলুম নূরে মদিনা মাদ্রাসা ও এতিমখানার মুহতামিম মাওলানা মো. জয়নাল আবেদীনও রমজান মাসে আবেদন করেছিলেন জানিয়ে বলেন, তাকেও ২ টন চালের বিপরীতে বাচ্চু ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। টাকা দেওয়ার আগে একটি ফরমে স্বাক্ষর নেন।
অনিয়মের বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে চালের ডিও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কয়েক জায়গায় অনিয়ম হয়েছে। নিউজ হলে সব দোষ আমার ওপর পড়বে। দয়া করে নিউজটি প্রকাশ করবেন না।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন বলেন, বিষয়টি জেনেছি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ব্যারিস্টার সজীব আহমেদ বলেন, ভুক্তভোগী কেউ আমার কাছে অভিযোগ করেননি। খোঁজ নিয়ে দেখব।