
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয় গত ১৬ জুন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুনানি শুরুর আগে সকালে ট্রাইব্যুনালের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এ মামলার এর আগের শুনানির দিনও একই জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
২৩ জুন রাত ১০টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারের সামনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে দলটির নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ২ জুলাই প্রায় একই জায়গায় দলটির ঢাকা মহানগরের পদযাত্রার গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর আগে ৩০ জুন হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ের সামনেও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
২৫ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ককটেল সদৃশ বস্তুর বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে টিএসসিজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
রাজনীতি কেন্দ্র করে ককটেল বিস্ফোরণ একসময় ছিল ঢাকা শহরের আতঙ্ক। মানুষ বাইরে বের হয়ে গাড়িতে চড়তেও ভয় পেতো। মাঝে কয়েক বছর এটা কম ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মসূচি বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ককটেল বিস্ফোরণ। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। পাড়া-মহল্লার সংঘর্ষেও ফুটছে ককটেল, যেটা আগে খুব বেশি দেখা যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য একটি চক্র সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এবং যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নেই, এমন জায়গা টার্গেট করা হচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে অস্ত্র হিসেবে ককটেল ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার আতঙ্ক ছড়ানো কিংবা কাউকে হুমকি দিতেও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এর আগেও নির্বাচনের আগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নিলে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।
কোনো বড় মামলার রায় ঘোষণা অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যাতে মানুষ ভয় পায়। এসব বিস্ফোরক ব্যবহার করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করা হয়। পুলিশের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে।- অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওমর ফারুক
ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হামলায় ককটেল বিস্ফোরণ
গত ২৮ জুন দিন-দুপুরে গাজীপুরে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় মহাসড়কে যানবাহন চলাচল।
সালিশে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ
১২ জুন মাদারীপুর সদরে বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে গান বাজানো ও নাচের সময় নারীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্তত ১৫টি দোকান ও বসতঘরে ভাঙচুর-লুটপাট চালানো হয়। আহত হয় ১০ জন।
জাজিরায় ‘খইয়ের মতো’ ফোটে ককটেল
শরীয়তপুরের জাজিরার জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশপাড়া এলাকায় সম্প্রতি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় খইয়ের মতো শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে এক তরুণের হাতের কবজিতে ক্ষত ও আরেকজন আহত হন। এর আগেও একই এলাকায় শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭ ককটেল উদ্ধার
১৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী মোতাহার হোসেন ভবন প্রাঙ্গণে কাঠবাদাম গাছের নিচ থেকে সাতটি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে ককটেলগুলো উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
যাত্রাবাড়ীতে ফ্লাইওভার থেকে পার্কে ককটেল নিক্ষেপ
২৩ মে রাত পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার শহীদ জিয়া পার্কের ভেতরে পশ্চিম পাশের ফটকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন পাঁচজন। ককটেলটি একটি জর্দার ডিব্বায় স্কচটেপ দিয়ে প্যাঁচানো ছিল।
যারা ককটেল বিস্ফোরণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে। ইতোমধ্যে যেসব জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা দেখে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হবে।-ডিএমপি মিডিয়ার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান
বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারের বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ
৩০ এপ্রিল গভীর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসঊদের বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। পুলিশ জানায়, সেখানে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ককটেল প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রহীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে দুবার ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা, একই সঙ্গে অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধারের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য একধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা।’
ঢাবি প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মুজিব হলের পেছনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জানা গেছে তাদের পল্লবী থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। এনেক্স ভবনের সামনে থেকে উদ্ধার করা অবিস্ফোরিত ককটেল নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। আমরাও একজন সহকারী প্রক্টরের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।’
রাজুতে যে পটকা ফাঁটানো হয়েছিল তার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমরা দুজনকে শনাক্ত করেছি। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তৎপর।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, কোনো বড় মামলার রায় ঘোষণা অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যাতে মানুষ ভয় পায়। এসব বিস্ফোরক ব্যবহার করে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করা হয়। পুলিশের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। পুলিশের কাছে আগে থেকে কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সঠিক তথ্য না থাকা কিংবা অপ্রস্তুত অবস্থার কারণেও এসব হচ্ছে।
জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়ার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, যারা ককটেল বিস্ফোরণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে। ইতোমধ্যে যেসব জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা দেখে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হবে।
আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনা বন্ধে পুলিশ কাজ করবে কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সব গোয়েন্দাসহ ডিএমপির প্রতিটি টিম কাজ করছে।