
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও কবি ফরহাদ মজহারের এক বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। তার বক্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ করছেন অভিজ্ঞরা। নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশে 'ক্ষমতার বদল' (রেজিম চেঞ্জ) ঘটিয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম যে অভিযোগ করে আসছিল, তার বক্তব্যে একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত ফরহাদ মজহারের বক্তব্যকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ফরহাদ মজহার বলেছেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়ে গেছে আমেরিকার সহায়তায় ‘রেজিম চেঞ্জ’। তিনি আমেরিকার অর্থনীতিবিদ ও বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষক জেফরি ডি. স্যাকসের বক্তব্যের সূত্র ধরে এ কথা বলেন। আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি স্যাকস গত বছরের ১৮ই আগস্ট বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে আমেরিকার 'ষড়যন্ত্রের' কথা বলেন। জেফরি স্যাকসের ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার ১৪ দিন আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং এর ১১ দিন আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়।
জেফরি স্যাকসের নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় এক বছর পর তাকে উদ্ধৃত করে বলা ফরহাদ মজহারের বক্তব্য প্রসঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এখনো কিছু বলা হয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কেউ কেউ এ বক্তব্যে 'বিব্রত' বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র সুখবর ডটকমকে জানায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই বক্তব্য নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এমন বক্তব্যের জন্য অনেকের তীব্র কটাক্ষের শিকার হচ্ছেন তিনি।
কেউ কেউ তার বক্তব্যকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন। কোন উদ্দেশ্যে হঠাৎ এমন বক্তব্য দিলেন তিনি, এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের তত্ত্ব-তালাশ করছেন অনেক নেটিজেন। বর্তমান সরকারে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হওয়ায় অনেকে তার বক্তব্যকে 'হালকাভাবে' না নেওয়ার কথা বলেছেন। ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা- এ প্রসঙ্গও উল্লেখ করছেন তারা।
ফরহাদ মজহার দৈনিক সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘গণঅভ্যুত্থান হয়ে গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘রেজিম চেঞ্জ’। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক জেফরি স্যাকস ১৮ই আগস্ট দাবি করলেন, ‘দ্য ভেরি স্ট্রং এভিডেন্স অব দ্য ইউএস রোল ইন টপলিং দ্য গভর্নমেন্ট অব ইমরান খান ইন পাকিস্তান রেইজেজ দ্য লাইকলিহুড দ্যাট সামথিং সিমিলার মে হ্যাভ অকারড ইন বাংলাদেশ’ (পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকার পতনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার খুবই শক্ত প্রমাণ রয়েছে। এ থেকে ধারণা তৈরি হয়, একই রকম কিছু বাংলাদেশে ঘটে থাকতে পারে)। কথাটা তো ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।’
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সমকাল ফরহাদ মজহারের এ সাক্ষাৎকার নেয়। গতকাল বুধবার (২রা জুলাই) ও আজ বৃহস্পতিবার (৩রা জুলাই) দুটি পর্বে তার সাক্ষাৎকার পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বিবিসির সাবেক সাংবাদিক কামাল আহমেদ ফেসবুক পোস্টে ফরহাদ মজহারের অভিমত প্রসঙ্গে বলেন, 'আমাদের কি আত্মবিশ্বাসের অভাব? না কি দেশের মানুষের প্রতি আস্থার অভাব? না হলে একাধিক বৃহৎশক্তির (শেখ হাসিনাকে ভারত ছাড়াও চীন, রাশিয়া প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছিল) মদদপুষ্ট কর্তৃত্ববাদকে যে দেশজ গণঅভ্যুত্থান সফলভাবে উৎখাত করেছে, তাকে যুক্তরাষ্ট্রের রেজিম চেঞ্জ বলে সন্দেহ রোপণের চেষ্টা কেন? ৮ই আগস্ট যদি প্রতিবিপ্লব হয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রতিবিপ্লবজাত সরকারপ্রধান ড. ইউনুসের ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকাকে ইতিবাচক বলার অর্থ কী?'
তিনি লেখেন, 'স্বৈরশাসনের আমলে প্রবাসীদের অনেকেই যে Transnational persecution (আন্তর্জাতিক নিপীড়ন) এর শিকার হয়েছেন, এ সত্যকে নাকচ করে দেওয়ার মানসিকতার ব্যাখ্যাই বা কী? রাষ্ট্র সংস্কারে প্রবাসী কারো অংশগ্রহণকে নাকচ করার দাবি তোলার আগে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের কাজটা প্রয়োজনীয় ছিল কী না, সেটাও কিন্তু বলা উচিত (বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের দাবিদার কারোর উচিত আগে নিজের তত্ত্বের পৌন:পুনিক অকার্যকারিতার ব্যাখ্যা দেওয়া)।' তিনি পোস্টে ফরহাদ মজহারের নাম উল্লেখ করেননি।
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও টকশো তারকা মাহবুব কামাল বলেন, 'বেশ কিছুদিন আগে মাহফুজ আলমের (তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা) কী যেন একটা লেখা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে। নিবন্ধ অথবা সাক্ষাৎকার। তো আমার এক কলিগ আমাকে বলছিলেন, ওটা পড়েছেন? আমি উত্তরে বলেছিলাম, আমি তো বেশিদিন বাঁচবো না, সময় সংক্ষিপ্ত বলে পড়ার আমার একটা প্রায়োরিটি লিস্ট আছে। আর যেসব কথা দু-একদিন পরেই বাতাসে মিলিয়ে যায়, সেগুলো আমি পড়ি না। লেখাটা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকারটাও আমি পড়বো না। আমার এত সময় নাই রে ভাই!'
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমের 'ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ' (প্রাধান্যশীল বক্তব্য) হলো, জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঘটনা পুরোপুরি সাজানো। এটা একটি ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থান। ক্ষমতার পালাবদলের জন্য আমেরিকা গত পাঁচ-ছয় বছর বা এরও আগে থেকে কাজ করেছে। এর জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলারও ঢেলেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের ওই বক্তব্যের সঙ্গে ফরহাদ মজহারের বক্তব্যের মিল পাচ্ছেন গবেষকরা।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য, আমেরিকার আসল লক্ষ্য বাংলাদেশ নয়, ভারত। তারা চায়, ভারতকে নিজের তালুর নিচে নিয়ে আসতে। বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যে ঘুঁটির প্রথম চাল। এসব প্রতিবেদনে তথ্যসূত্র হিসেবে বিভিন্ন উৎসের কথা বলছে সংবাদমাধ্যমগুলো। এর মধ্যে আছে, নিউইয়র্ক সফরকালে অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য এবং ‘গ্রেজোন’ নামের আমেরিকার একটি ওয়েব পোর্টালের 'দলিল'। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সফরকালে ড. ইউনূস তার ওই সময়ের বিশেষ সহকারী, পরে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এই হচ্ছে আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’। আর আন্দোলনটা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সাজানো-গোছানো।
ভারতীয় মিডিয়ার ব্যখ্যায়, জুলাই অভ্যুত্থান মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত কোনো আন্দোলন নয়। এটি একটি পরিকল্পিত 'চক্রান্ত'। ভারতীয় অনেক গণমাধ্যম 'গ্রেজোনের' ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের একটি ‘গোপনীয় দলিল' প্রকাশ করে। এ 'দলিল' উদ্ধৃত করে গ্রেজোন বলেছে, পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকেই গণতন্ত্র বিকাশের নামে শেখ হাসিনা সরকারকে হটিয়ে একটি মার্কিনপন্থী সরকার গঠনের চক্রান্তে রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট যুক্ত। এ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে, যখন শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেটাও রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের ‘গ্র্যান্ড প্ল্যানের’ অংশ।