
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের এই সময়ে বাংলাদেশ ও তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক সাউথ-সাউথ তথা দক্ষিণ-দক্ষিণ (গ্লোবাল সাউথের দুটি দেশের মধ্যকার) সহযোগিতার এক চমৎকার উদাহরণ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। ঐতিহাসিক বন্ধন এবং প্রায় একই রকমের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এ দুটি দেশকে দীর্ঘকাল ধরে সংযুক্ত রাখলেও আরও গভীর কৌশলগত জোটের সম্ভাবনা এখনো অনেকাংশে অনাবিষ্কৃত।
বাংলাদেশ ও তুরস্কের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে সম্ভাবনাময় হলেও বাণিজ্যিকভাবে এখনো তুলনামূলকভাবে সীমিত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তুরস্কে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৫৮১ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আমদানি ছিল ৪২৪ মিলিয়ন ডলার। এই বিদ্যমান বাণিজ্য ভারসাম্য আরও বেশি লেনদেনের শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করলেও, প্রকৃত সুযোগ মূলত গভীর শিল্প সহযোগিতার বিকাশে।
সম্প্রতি তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রী ওমের বোলাতের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে তুরস্ককে বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই অঞ্চলের চাহিদা মেটাতে দেশের তরুণ কর্মশক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ওপর জোর দেন। এই প্রস্তাব কেবলই আকাঙ্ক্ষা নয়; এটি বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির একটি বাস্তবসম্মত মূল্যায়নকে প্রতিফলিত করে, যা দেশটিকে তুর্কি উৎপাদন ও প্রতিরক্ষাশিল্পের জন্য এক আদর্শ কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
ক্রমবর্ধমান মাল্টিপোলার বা বহু মেরু বিশ্বের প্রেক্ষাপটে জটিল ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশলগত অংশীদারত্ব অপরিহার্য। বৈশ্বিক মঞ্চে উদীয়মান শক্তি হিসেবে স্বীকৃত তুরস্ক বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক গভীরতা ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি উভয়ই ধারণকারী একটি জাতি হিসেবে দেখে। এশিয়ায় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান এবং এর ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব দেশটিকে এই অঞ্চলে তুরস্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত করেছে।
অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের সক্রিয় কূটনীতি নিঃসন্দেহে বিশ্বমঞ্চে আংকারার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশ এই অংশীদারত্ব কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে গভীর সহযোগিতা বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
অন্যদিকে, তুরস্কের ২০১৯ সালে চালু করা ‘এশিয়া অ্যানিউ ইনিশিয়েটিভ’ (এএনআই) এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ককে বহুমুখী করার লক্ষ্যে পরিচালিত, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এএনআইয়ের অংশ হিসেবে তুরস্ক বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে সক্রিয়ভাবে আগ্রহী, কারণ দেশটি তুরস্কের অন্যতম পুরোনো অংশীদার।
গত এক দশকে তুরস্ক লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে। তাদের এই অভিন্ন অভিজ্ঞতা এক নতুন বৈশ্বিক অভিবাসন নীতিকাঠামোর পথ প্রশস্ত করতে পারে। এ ছাড়া, মানবিক সহায়তায় তাদের সহযোগিতা গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বাধীন সংকট মোকাবিলা ব্যবস্থার একটি নজির স্থাপন করতে পারে, যা মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আরও স্থানীয় ও সংস্কৃতি-সংবেদনশীল পদ্ধতির প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে।
তুরস্কের হাই-টেক শিল্পে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে প্রমাণিত দক্ষতার কথা বিবেচনা করা যাক। এই দক্ষতা বাংলাদেশের বিশাল ও গতিশীল কর্মশক্তির সঙ্গে যুক্ত করে উভয় দেশ একটি যৌথ শিল্পবিপ্লব ঘটাতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং দেশ দুটির নাগরিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে আসন্ন যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক প্রতিরক্ষা শিল্পসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। মূল প্রশ্ন হলো, এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কেবল অস্ত্র বিক্রির বাইরে যৌথ প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সহ-উৎপাদন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারবে কি না, যা উভয় দেশের জন্য একটি আরও স্থিতিশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলবে।
বাংলাদেশ ও তুরস্ক সম্পর্ক এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ঐতিহাসিক বন্ধন ও অভিন্ন মূল্যবোধ একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করলেও এই অংশীদারত্বের আসল সম্ভাবনা ঐতিহ্যবাহী কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক লেনদেনের ঊর্ধ্বে একটি কৌশলগত জোট গঠনের মধ্যেই নিহিত।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা ও মানবিক বিষয়ে সহযোগিতা গভীর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও তুরস্ক কেবল তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থই রক্ষা করবে না, বরং একটি আরও স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সংগত বিশ্বব্যবস্থা গঠনেও অবদান রাখবে। এখন প্রশ্ন হলো, উভয় দেশেরই কি এই সুযোগ কাজে লাগানোর মতো দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কৌশলগত প্রজ্ঞা রয়েছে?