
জাতিসংঘের পরমাণু কর্মসূচিবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ’র মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, ইরানের ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে, তেহরানের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
আইএইএ প্রধান গত সপ্তাহে এই তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সংস্থাটি বিশ্বাস করে জুনে ইসরায়েলের সাথে ১২ দিনের যুদ্ধের পরেও ইরানের বেশিরভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সরবরাহ অক্ষত রয়েছে এবং সেটি এখনও ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির ভেতরেই মজুত আছে।
রাফায়েল গ্রোসি ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত সুইস সংবাদপত্র নিউয়ে জুরচার জেইতুংকে (এনজেডজেড) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জাতিসংঘের সংস্থাটির অনুসন্ধানে জানা যায়, ইরানের ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের ‘অধিকাংশই’ ইসফাহান এবং ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রগুলিতে মজুত রয়েছে এবং কিছু আছে নাতাঞ্জেও।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক অনুমান করেন, সব মিলিয়ে ইরানের কাছে এখনও প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আছে।গত মাসে আইএইএ এর একটি গোপন প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, ১৩ জুন পর্যন্ত ইরানের কাছে ৪৪০.৯ কিলোগ্রাম (৯৭২ পাউন্ড) পর্যন্ত ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ছিল। গ্রোসি এনজেডজেডকে জানান, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কাছে এখনও প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম রয়েছে। এতে মনে হয়, আইএইএ এর মূল্যায়ন অনুযায়ী, দেশটির মজুত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বেশিরভাগই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
জুনে ইরানের সাথে ১২ দিনের যুদ্ধের সময় ইসরায়েল ইসফাহান এবং নাতাঞ্জ উভয় পারমাণবিক কেন্দ্রেই আঘাত হানে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের একার পক্ষে টার্গেট করা সম্ভব ছিল না এমন ভূগর্ভস্থ ও দুর্গম ফোরদো স্থাপনাসহ এই দুটি স্থাপনাতেও হামলা করে।গ্রোসি এনজেডজেডকে বলেন, এই তিনটি কেন্দ্রই হামলায় “ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত” হয়েছে, যার অর্থ হলো আইএইএ কেবল ইরানের পূর্ণ সহযোগিতা পেলেই ওই কেন্দ্রগুলিতে প্রবেশ করতে পারবে এবং ভেতরে থাকা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।তিনি বলেন, ‘‘এটি কেবল তখনই ঘটবে যখন ইরান এটিকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে দেখবে।’’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলেছেন, যুদ্ধে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
চলতি বছরের ২৫ জুন একটি হোয়াইট হাউস ওয়েবসাইটের নিবন্ধে বলা হয়েছে: ‘‘পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক থেকে পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ এবং গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের সদস্যদের সকলেই একমত যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।’’
ইসরায়েল মনে করে, এই যুদ্ধ ইরানের কর্মসূচিকে ‘কয়েক বছর’ পিছিয়ে দিয়েছে। তবে, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের পরিণতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেনি।যদিও আইএইএ বিশ্বাস করে যে, তারা জানে ইউরেনিয়াম কোথায় অবস্থিত, তবুও গ্রোসি বলেন, ইরানের অসহযোগিতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি উত্তরহীন রয়ে গেছে।
তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আমরা কি এই ইউরেনিয়ামের কাছে যেতে পারব? এবং তারপরে এর কী হবে? ইরান কি এটি রাখতে চাইবে, এটি কি আবার এর সমৃদ্ধকরণের মাত্রা কমিয়ে দেবে, নাকি ইরান এই ইউরেনিয়াম বিদেশে সরিয়ে দেবে? অনেক বিকল্প রয়েছে।’’
ইসরায়েলি হামলাগুলির পর্যাপ্ত নিন্দা জানাতে ব্যর্থতার জন্য সংস্থাটিকে অভিযুক্ত করেছে ইরান। এই অভিযোগে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধের পর ইরান আইএইএ-এর সাথে তার সহযোগিতা স্থগিত করেছে।পরিবর্তে, তেহরান এবং আইএইএ সহযোগিতার একটি নতুন কাঠামোতে সম্মত হয়েছে, যা ইরানের নিরাপত্তা সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার পরই কেবল জাতিসংঘ পারমাণবিক পরিদর্শকদের পারমাণবিক কেন্দ্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
তা সত্ত্বেও, গ্রোসি এনজেডজেডকে বলেছেন, তিনি ভবিষ্যতে উন্নত সহযোগিতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না, কারণ ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে আসেনি। তেহরান জোর দিয়ে বলছে, দেশটি এখনও তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিরোধের কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে প্রস্তুত।তিনি ইরানের প্রতি একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানান, যা ইসরায়েল ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার উপর হঠাৎ আক্রমণ শুরুর পর স্থগিত করা হয়েছিল।তিনি বলেন, ‘‘একসাথে আলোচনার টেবিলে বসা আমাদের আরও একটি বোমা হামলা এবং আক্রমণের বিপদ থেকে বাঁচায়।’’
ইরানের বেশিরভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এখনও দেশটির ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির ভেতরেই রয়েছে, আই এই এ এর এমন মূল্যায়ন তেহরানও স্বীকার করে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি গত মাসে বলেছিলেন, ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রগুলির ধ্বংসস্তূপের নিচে সমৃদ্ধ পারমাণবিক উপাদানগুলি রয়েছে।
টাইমস অব ইসরাইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করার কথা অস্বীকার করে, তবে দেশটি এমন স্তরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে যার কোনো শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নেই। ইরান আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলি পরীক্ষা করতে বাধা দিয়েছে এবং দেশটির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়িয়েছে। জেরুজালেমের মতে, জুনে ইসরায়েল পরমাণু কর্মসূচিটির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করার ঠিক আগে ইসলামি প্রজাতন্ত্র অস্ত্রায়নের দিকে পদক্ষেপ নিয়েছিল।