
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর তার প্রশাসন অভিবাসন ও উচ্চশিক্ষা নীতিতে যেসব কড়াকড়ি পদক্ষেপ নিয়েছে, তা শুধু নীতিগত পরিবেশকে নয়- আঘাত করেছে হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ও উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষাকে।
সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড থেকে আসা ২০ বছর বয়সী ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দ্রে ফা’আসো জানান, ডিগ্রি শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়াই এখন আমার অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, নীতিমালা হঠাৎই বদলে যেতে পারে, আর তখন আমি দেখবো প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে ইয়েল এবং আমার থাকার অধিকার রাজনৈতিক ছলচাতুরীর অংশ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি আশাবাদী যে, কোনো সমস্যা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারব। তবে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে- যদি কোনো কারণে আমাকে সেকেন্ডারি স্ক্রিনিংয়ে (দ্বিতীয় পর্যায়ের তল্লাশি) নেয় বা কোনো অকারণে আটক করে, তখন কী হবে। আমি একা নই, অনেকেই এ ভাবনায় রয়েছেন।
সিঙ্গাপুর থেকে আসা ওহাইওর একটি কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত, তবু ভয় পাই। প্রতিবাদ-সমাবেশ এড়িয়ে চলি, সবসময় কাগজপত্র সঙ্গে রাখি। তবু মনে হয় কোনো একদিন হয়তো আমাকে আটকে রাখা হবে।
একইভাবে, হাভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথে স্নাতকোত্তর পড়তে যাওয়া এক পূর্ব ইউরোপীয় শিক্ষার্থী জানান, ১০ বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এবং বৈধ ভিসা থাকার পরও তিনি আতঙ্কিত বোধ করছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের নানা সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ভিসা প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, কয়েকশ শিক্ষার্থীর আইনগত মর্যাদা বাতিল ও পরে পুনর্বহাল, ভিসা আবেদনকারীদের সোশ্যাল মিডিয়া যাচাই, নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, গবেষণার তহবিল কাটছাঁট, ও ফিলিস্তিনিপন্থি আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সে সঙ্গে চীনা শিক্ষার্থীর ভিসা ‘আক্রমণাত্মকভাবে’ বাতিল করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া এক পর্যায়ে প্রশাসন হার্ভাড আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি ঠেকাতে চেয়েছিল, যা নিয়ে আইনি লড়াই শুরু হয়। হার্ভাড বলছে, এটি ছিল হোয়াইট হাউসের রাজনৈতিক প্রতিশোধ।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ লাখের বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ছিল, যা মোট শিক্ষার্থীর ৬ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালের মে মাসে এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার আগ্রহ মহামারি পরবর্তী সময়ে সর্বনিম্নে নেমেছে।
নাফসা নামের আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিষয়ক সংগঠনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ বছর নতুন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০-৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে, ফলে সামগ্রিক ভর্তি হার ১৫ শতাংশ কমতে পারে।
এ হ্রাসের জন্য দায়ী করেছে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ভিসা ইন্টারভিউ ও প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন, ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের স্বল্পতা এবং নতুন ভিসা যাচাই প্রক্রিয়াকে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আর্থিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এসব শিক্ষার্থী সাধারণত দেশীয় শিক্ষার্থীদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি টিউশন ফি প্রদান করে থাকেন এবং তারা প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখেন।
বিশেষভাবে ইরানি শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। ইরানের নাগরিকদের ওপর নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন।
২৩ বছর বয়সী ইরানি রোমিনা আয়োউবি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হলেও ভিসা জটিলতার কারণে যোগ দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি খুব কষ্টে ভিসার জন্য ইন্টারভিউ দিতে ইরানের বাইরের একটি দেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন দেখি একমাত্র আমিই আসতে পারছি না।
এদিকে ২৭ বছর বয়সী ইরানি মাহিয়া জানান, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণ স্কলারশিপ পেয়েও ভিসা প্রত্যাহারের ই-মেইল পেয়ে তাকে ফ্লাইট, বাসা বাতিল করতে হয়েছে। এরপর আসে নিষেধাজ্ঞার খবর।
তিনি বলেন, আমার সব সহপাঠীরা যখন নিউইয়র্ক সিটি ও কলম্বিয়াতে তাদের একাডেমিক যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, তখন আমি শুধু ইরানি হওয়ার কারণে তা করতে পারছি না- এটা খুবই হতাশাজনক।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুযোগ পেলেও ভিসা পাননি ৩৬ বছর বয়সী দোনিয়া মোভাহেদি নাঘানি। তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন যেন ভেঙে পড়েছে। এখন তিনি কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
আরও অনেক ইরানি শিক্ষার্থী জানান, তারা তাদের ভর্তি স্থগিত করেছেন, আশায় আছেন ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অনেক ইরানি শিক্ষার্থী নিজেদের ‘নিরুপায়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা শুধু আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুযোগ চাই, জাতীয়তা দিয়ে নয়, আমাদের সম্ভাবনা দিয়ে বিচার করা হোক।