Image description

২০১৫ সালের ১৫ জুন। স্থান ভুটানের রাজধানী থিম্পু। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে (বিবিআইএন) নিয়ে যে উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডোর গড়ার প্রচেষ্টা তা আরও বেগবান করতে সেই দিন সই করা হয় মোটর ভেহিকলস অ্যাগ্রিমেন্ট (এমভিএ)। এর লক্ষ্য ছিল চুক্তিতে সই করা চার দেশের মধ্যে যান চলাচল বাড়ানো। দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আঞ্চলিক সংহতি।

এর ঠিক ১০ বছর পর অর্থাৎ চলতি ২০২৫ সালের ১৯ জুন চীনের কুনমিং শহরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চীনের বৈঠকের পর থেকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই অঞ্চলে নতুন এক 'চার-জাতি' জোট বা 'কোয়াড' গঠনের আভাস দিয়ে যাচ্ছেন।

গত ৮ জুলাই পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধের শিরোনামে প্রশ্ন রাখা হয়, 'সাউথ এশিয়ান কোয়াড?' এতে বলা হয়—গত মে ও জুনে চীনের সহায়তায় পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

আরও বলা হয়—চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে ত্রিদেশীয় স্ট্র্যাটিজিক ডায়ালগ ফোরাম এক দশক আগে গঠিত হলেও সাম্প্রতিক কৌশলগত আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা আবার গতি পাচ্ছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হওয়ায় ত্রিদেশীয় জোটটি আবার আলোচনায় এসেছে।

শুধু তাই নয়—গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বৈঠক সেই ত্রিদেশীয় জোটকে 'চার-জাতি জোট'র রূপ দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অর্থাৎ, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন জোটের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

অনেকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে 'এক ঘরে' করতে হয়ত এই জোটের ভাবনা।

এতো হলো সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। একটু ফিরে দেখা যায় সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে।

ভারতের 'ব্যর্থতা'

২০১৪ সালের নভেম্বরে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ১৮তম সম্মেলনে ভারত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়াতে ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য চুক্তির প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে পাকিস্তান আপত্তি জানানোয় ভারত সেই ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। প্রাথমিকভাবে সঙ্গে পায় বাংলাদেশ ও নেপালকে। আগ্রহ দেখায় ভুটান।

এরপর বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক জোট গড়ার ও জোটকে সংহত করতে ২০১৫ সালের ১৫ জুন সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এমভিএ সই হয়।

'স্বপ্ন' দেখানো হয়—এই চার দেশের মানুষ নির্বিঘ্নে নিজেদের গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারবে। শুধু গণ-মানুষের যোগাযোগ নয় পণ্য পরিবহন করা হবে দ্রুততার সঙ্গে।

ভারতের 'নেতৃ্ত্বাধীন' বিবিআইএন'র উদ্দেশ্য জোটের দেশগুলোর জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে সীমান্ত পারাপারের জটিলতা ও পণ্যের ওপর ভিন্ন ভিন্ন শুল্ক বাধা দূর করা। কিন্তু, গত ১০ বছরে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখতে পায়নি কোনো দেশের সাধারণ মানুষ।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল 'মোটরগাড়ি চুক্তি'কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও ভুটান গত বছর এই জোট-প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ ও ৬ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের বৈঠকে যোগ দেওয়া ভুটানি প্রতিনিধি দল সেই আগ্রহের কথা জানায়। সংবাদ প্রতিবেদনগুলোয় বলা হয়, মূলত পরিবশ ও অবকাঠামোগত কারণে ভুটান তখন পর্যন্ত 'মোটরগাড়ি চুক্তি'তে যোগ দিতে পারেনি।

সেই দুই দিনের বৈঠকে জোট-চুক্তির অগ্রগতি ও পণ্যবাহী গাড়ির চলাচলের খসড়া প্রটোকল নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এর আগের বৈঠকটি হয়েছিল নয়াদিল্লিতে, ২০২২ সালের ৭ ও ৮ মার্চ।

দুই বৈঠকের মধ্যে দুই বছরের ব্যবধান বুঝিয়ে দেয়, এই 'জোট' কতটা ধীরগতিতে চলছিল।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ উন্নত করতে ভারত এক বিলিয়ন ডলারের বেশি অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ৫৫৮ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে সড়ক তৈরি ও বিদ্যমান সড়কের উন্নয়নে। এর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়ানো যাবে।

বাস্তবতা হচ্ছে—গত বছর আগস্টে বাংলাদেশে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে 'ভারতপন্থি' আখ্যা পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয় নয়াদিল্লি। বাণিজ্যিক সম্পর্কেও সৃষ্টি হয় টানাপোড়েন। গত এক বছরে এই দেশ দুইটির সম্পর্ক 'স্বাভাবিক' হওয়ার ইঙ্গিতটিও দেখা যাচ্ছে না।

দীর্ঘ ১০ বছর পর দেখা যাচ্ছে—চির-প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে 'সমমনা' দেশগুলোকে নিয়ে ভারতের গড়া বিবিআইএন যেন '১০ বাও পানির নিচে'। আর নিজের গাড়ি নিয়ে বাঙালির বিদেশ যাওয়া যেন 'সুদূর পরাহত'।

চীন পারবে কি?

বাংলাদেশে পটপরিবর্তনের পর বাস্তবতা বদলে যায় দক্ষিণ এশিয়ায়। সুযোগ আসে চীন-পাকিন্তান-আফগানিস্তান নিয়ে বিদ্যমান ত্রিদেশীয় 'জোট'কে 'চার-জাতি জোট' হিসেবে গড়ে তোলার। দিল্লির সঙ্গে ঢাকার রাজনৈতিক 'দূরত্ব' বেড়ে যাওয়ায় ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ইসলামাবাদ। এই প্রক্রিয়ায় পাশে থাকে বেইজিং।

ডন'র 'সাউথ এশিয়ান কোয়াড?' নিবন্ধে আরও বলা হয়—ছোট জোট গড়ার বিষয়ে পাকিস্তানের আগ্রহের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এখন এ ধরনের ছোট ছোট জোট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির 'স্তম্ভ'।

সার্কের 'অকার্যকারিতা' নিয়ে ইসলামাবাদ 'উদ্বিগ্ন' উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়—২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন বর্জন করে ভারত কার্যত উপ-আঞ্চলিক জোট গড়ার দিকে পাকিস্তানকে ঠেলে দিয়েছে।

নয়াদিল্লি সার্কের পরিবর্তে বিমসটেকের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় এই অঞ্চলে পাকিস্তান অনেকটা 'একঘরে' হয়ে পড়ে। আর এ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া পাকিস্তান।

নিবন্ধে দাবি করা হয়—সাম্প্রতিক সময়ে চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান জোট বেশকিছু সাফল্য দেখিয়েছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান রেলপথ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এই কৌশলগত জোট আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ কমাতে কাজ করছে।

এসব 'সাফল্য' পাকিস্তানকে আগ্রহী করে তোলে বাংলাদেশকে জোটসঙ্গী করতে।

এ ছাড়াও, ইসলামাবাদ চায় বেইজিং দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করুক। অর্থাৎ, এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব কমাতে চীনের উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে পাকিস্তান।

চীনকে সার্কের অংশীদার করতে পাকিস্তান যে প্রস্তাব দিয়েছিল ভারত তা প্রত্যাখ্যান করায় ইসলামাবাদ সার্কের 'অকার্যকারিতার' সুযোগ নিয়ে বেইজিংকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন জোটের 'স্বপ্ন' দেখছে। বলা বাহুল্য, সেই জোট হবে চীনের নেতৃত্বে।

তবে ইতোমধ্যে এই সম্ভাব্য উপ-আঞ্চলিক জোটকে 'হুমকি' হিসেবে নিয়েছে ভারত। গত ৯ জুলাই দেশটির চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনীল চৌহান বলেন, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট ভারতের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন—ঠিক ১০ বছর আগে সার্ক সদস্যদের নিয়ে আলাদাভাবে যে উপ-আঞ্চলিক জোট গড়তে গিয়ে 'ব্যর্থ' হয়েছিল ভারত সে রকম উপ-আঞ্চলিক জোট গড়তে কতটা সফল হবে চীন? অথবা, ভারতের 'ব্যর্থতা' থেকে কতটুকু শিক্ষা নেবে চীন?