
আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি এবং বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ফোর্দোসহ ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা হয়েছে। ট্রাম্প দম্ভোক্তি করেছেন যে, ‘ফোর্দো ইজ গন’ অর্থাৎ ‘ফোর্দো শেষ’। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বি-টু স্টিলথ’ বোমারু বিমান এ হামলা চালায়। হামলার পর বিমানগুলো নিরাপদে মার্কিন দ্বীপপুঞ্জ গুয়ামে ফিরে এসেছে বলেও প্রশান্তি অনুভব করেন ট্রাম্প। তিনি সফল হামলার জন্য ইসরায়েলের কসাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকেও অভিনন্দন জানান। বি-টু বোমারু বিমান দিয়ে ছয়টি বাংকার ধ্বংসকারী বোমা মারা হয়েছে। ইরানের ফোর্দো প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাটি ভূগর্ভের অনেক গভীরে। তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু করেছে। তিনি বলেছেন, ট্রাম্পের এ হামলা গর্হিত। ইরান সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ‘সব বিকল্প’ সংরক্ষণ করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির একজন উপদেষ্টা বলেছেন, তারা হরমোজ প্রণালি বন্ধ এবং মার্কিন নৌবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ‘এখন আমাদের পালা।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই হামলা চালিয়েছে। এই হামলাকে অসাংবিধানিক বলেছে মার্কিন রাজনীতিকরা। তারা বলছেন, ট্রাম্পকে ইমপিচমেন্টের ভিত তৈরি করেছে ইরানে হামলা।
বাংলাদেশের মানুষের মন এখন যুদ্ধের দিকে। মার্কিন ন্যক্কারজনক হামলার পর যুদ্ধের গতি কোনদিকে মোড় নেয়, সেটাই মানুষের চিন্তার বিষয়। কারণ ইরান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। অন্যায় যুদ্ধের শিকার হয়েছে ইরান। ইরানের প্রতি প্রচণ্ড সহানুভূতি আছে বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে মানুষের মনে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, বিশ্বযুদ্ধের দিকে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি থেমে নেই। ভোটের লড়াই ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রী বিশেষ করে প্রার্থীরা নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় এখন বেশি সময় দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের মেরূকরণ
গণহত্যাসহ ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে দেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। দলটির নিবন্ধনও নির্বাচন কমিশন থেকে স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগের চিহ্নিত বেশির ভাগ নেতাই একে একে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন অথবা আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ তাদের নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী-সমর্থক যারা দেশে আছেন, তারা চুপচাপ আছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন দলে ভিড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিদেশে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা তাকিয়ে আছেন তাদের পক্ষে কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় কি না। তারা আশা করছেন কোনো কারণে যদি ড. ইউনূসের সরকার ফেল করে, তাহলেই হলো। সুযোগটি তারা লুফে নেবেন। তাদের সেই সুযোগ আদৌ আসবে কি নাÑসেটা পরের বিষয়। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
নির্বাচনের জন্য বিএনপি এখন বড় দল। প্রার্থীর অভাব নেই এ দলে। নির্বাচন করার জন্য প্রতিটি আসনে চার-পাঁচজন করে প্রার্থী মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। কে মনোনয়ন পাবেন, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। ৩০০ আসনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন শীর্ষ নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট শরিক এবং সমমনা দলগুলোর আগ্রহী প্রার্থীরাও মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। কয়েকটি ইসলামি দল, কর্নেল অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি এবং ড. কামাল হোসেনের গণফোরামসহ বাম দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি সমন্বয় করে প্রার্থী দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
বিএনপির পরেই বড় দল হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত ৩০০ আসনে নির্বাচনের ঘোষণা করে ইতোমধ্যে বেশির ভাগ প্রার্থী ঠিক করে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঘোষিত জামায়াত প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট আসনে জনসংযোগও করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি জামায়াত অন্যান্য ইসলামিক দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। খবর বের হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসহ অন্তত ১০টি দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের জন্য সমঝোতার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ছাত্রদের দল এনসিপির সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচন করার ব্যাপারেও তাদের চেষ্টা রয়েছে। তবে এনসিপি নির্বাচনে তাদের চূড়ান্ত চিন্তাভাবনা এখনো প্রকাশ করেনি। দেশব্যাপী এনসিপির দল গঠন এখনো সম্পন্ন হয়নি। দল গঠন ও নিবন্ধন নিয়ে তারা এখন ব্যস্ত। তবে কোনো কোনো নেতা বলেছেন, ৩০০ আসনে মনোনয়নের চিন্তাভাবনা এনসিপির রয়েছে। তারা এও আশা করছেন যে, শেষ মুহূর্তে অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলা, অতীতে বিভিন্ন দলে থাকা জনপ্রিয় নেতারা এবং বিএনপির মনোনয়ন-বঞ্চিতরা তাদের প্রার্থী হতে পারেন।
জাতীয় পার্টি নির্বাচন নিয়ে বেকায়দায় আছে। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় তাদের পুরো ক্ষোভ গিয়ে পড়তে পারে জাতীয় পার্টির ওপর। তা ছাড়া জাতীয় পার্টি ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ হয়ে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন দিয়ে গেছে। ফলে মাঠে তাদের কতটা তোপের মুখে পড়তে হয়, সেই ভয়ও আছে। গত কয়েক মাসে জাতীয় পার্টিকে কয়েকবার জনরোষে পড়তেও দেখা গেছে। দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলও চরমে। তারপরও জাতীয় পার্টি নির্বাচনের জন্য তৈরি হচ্ছে। খবর বের হয়েছে কিছু কিছু নির্দোষ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নির্বাচনের জন্য অসংখ্য ছোট দলেও নির্বাচনমুখী কর্মসূচি নিতে দেখা যাচ্ছে। নতুন নতুন দল গঠনও হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে ইতোমধ্যে ১০০-এর কাছাকাছি নতুন দল নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত করেছে। গতকাল পর্যন্ত ছিল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন। এদিন তরুণদের দল এনসিপি নিবন্ধন চেয়ে ইসিতে দরখাস্ত করেছে। নির্বাচন কমিশন থেকে যে কটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হবে, তারাও নির্বাচনের জন্য বড় দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া বা আসন পাওয়ার ব্যাপারে তৎপরতা চালাবে।
কেমন হবে নির্বাচন
দেশের মানুষের প্রশ্নÑআগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ এবং লন্ডন সফরকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে ঘোষণা করেছেন তিনি ‘ইতিহাসসেরা একটি সুন্দর নির্বাচন’ দেশবাসীকে উপহার দিতে চান। শেখ হাসিনা ১৫ বছরে তিনটি একতরফা নির্বাচন করে দেশের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছেন। দেশবাসীও নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের একতরফা প্রহসনের নির্বাচনের পর একটি ইতিহাসসেরা সুন্দর নির্বাচনের আশা তাই ড. ইউনূসেরই শুধু নয়, সারা দেশের মানুষেরও। কারণ গত তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। তাদের ভোট দেওয়ার প্রয়োজনও হয়নি। এবার যদি তারা নিজের পছন্দের প্রার্থীকে কোনো ধরনের ভয়ভীতি ও চাপমুক্ত পরিবেশে ভোট দিতে পারেন, তাতেই তারা খুশি হবেন। ১৫ বছর মানুষের ভোট দিতে না পারার ক্ষোভও আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচনে যেখানে আওয়ামী লীগ নেই, সেই নির্বাচন কতটা ইতিহাসসেরা নির্বাচন হবে? নির্বাচনটি তো অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে না। এ সম্পর্কে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ডিক্যাব টকে অংশ নিয়ে বলছেন, আওয়ামী লীগ না থাকলেও জনগণের অংশগ্রহণ সঠিকভাবে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনটি ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে। জাতিসংঘের কাছে ইনক্লুসিভ নির্বাচন মানে হচ্ছে প্রত্যেক ভোটার যেন স্বাধীন ও নির্ভয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার গত ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে নির্বাচন ভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সমর্থন করেছি। আশা করি আগামী জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসসেরা নির্বাচন হবে। আর সেটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষ।’
ইতিহাসের সুন্দর নির্বাচন কিংবা ভালো নির্বাচনের অর্থ হলো তফসিল ঘোষণার আগ্রহী সব প্রার্থী বিনাভয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন, মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা কোনো ফোন পেয়ে প্রভাবিত হবেন না, প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে প্রচার চালাবেন, কেউ কারো প্রচারে বাধা দেবেন না, প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে এবং কোনো প্রার্থীকে কোনো দল, সরকার বা এজেন্সির চাপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে চলে যেতে হবে না। কোনো বিরোধ বা মারামারি যাতে না হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে সে দায়িত্ব পালন করবে। ভোটের দিন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে এবং ভোটাররা নিজের ভোট নিজে দেবেন, যাকে খুশি তাকে দেবেন।
এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেশে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সেই নির্বাচন কমিশন শেখ হাসিনার কথার বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করেনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা, কে এম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল তাদের কার্যক্রমের দ্বারা খলনায়ক সিইসি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন। প্রথমদিকে নতুন কমিশনের কিছু অতিকথন মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। তবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন শক্ত এবং নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি সাংবাদিকদের নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেওয়ার জন্য তার নেতৃত্বাধীন কমিশন বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করছি। নির্বাচনে ইসি রেফারির ভূমিকায় থাকবে। যারা খেলবে খেলুক, যারা জিতবে জিতুক। আমাদের শপথ নিরপেক্ষভাবে কাজ করার, কোনো দলের জন্য লেজুড়বৃত্তি না করার, আইন অনুযায়ী এবং ন্যায়সংগতভাবে কাজ করার।’
তবে সিইসি শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে না, একটি ভালো নির্বাচনের যে শর্তগুলো রয়েছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়া, নিবন্ধন বাতিলÑসেই বিষয়গুলো সিইসি বা নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও প্রভাবমুক্ত থেকে করতে হবে। সিইসি নাসির উদ্দীনই জানিয়েছেন, গত তিনটি নির্বাচনে ২০ লাখ ভোটার কবর থেকে এসে ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ এরা মৃত ভোটার। এদের জায়গায় দুষ্কৃতকারীরা এসে ভোট প্রদান করেছে। নতুন ভোটার তালিকায় যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
কেমন ছিল বিগত ১২টি নির্বাচন
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২টি নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে চারটি নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর বাকিগুলো হয়েছে দলীয় সরকার বা সামরিক শাসনের অধীনে। ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনটি হয় স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সময়। ওই নির্বাচনে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ব্যানারে অংশ নিয়েছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। তিনি এখন আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। শেষ সময়ে তিনি সিপিবির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার আত্মজীবনী ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে তিনি লেখেন, ‘১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমরা জানতাম আওয়ামী লীগ জিতবে; কিন্তু কিছু আসন বিরোধী শিবিরেও যাবে।’ তার মতে, ওই নির্বাচনে ১৫ থেকে ২০টি আসনে বিরোধী দল জয়লাভ করেছিল। কিন্তু তাদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়। আর সাতটি আসনে আওয়ামী লীগের বাইরে বিজয় দেখানো হয়। আওয়ামী লীগের বিজয়ী আসন দেখানো হয় ২৯৩টি। নির্বাচনের পর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশে কোনো বিরোধী দল নেই। তখন বিভিন্ন পত্রিকায় এটি শিরোনাম হয়েছিল।
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯টি, জাতীয় লীগ ২টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, জাসদ ৮টি, মুসলিম লীগ ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট ২টি আসন পায়। এ ছাড়া ন্যাপ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দল ও জাতীয় একতা পার্টি একটি করে আসন জয়লাভ করে। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়লাভ করে। মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তখনো দেশে সামরিক শাসন জারি ছিল এবং নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। তবে সেই নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হয়, সেই সংসদ ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণবন্ত একটি সংসদ। সংসদ নেতা ছিলেন বিএনপির শাহ আজিজুর রহমান এবং বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান খান। সংসদে মাওলানা আব্দুর রহিম, খান এ সবুর, মহিউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মোহাম্মদ তোয়াহা, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানরা ছিলেন।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে এরশাদের আমলে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নিলেও বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। এ নির্বাচনটি ‘ভোট ডাকাতি’র নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরে বিরোধী দলের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা পদত্যাগ করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ফিরে আসেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় এরশাদের আমলেই। এ নির্বাচনে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে মাত্র ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদ নেতা হন এবং আ স ম রব হন বিরোধীদলীয় নেতা। রবকে তখন বলা হতো গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা। বিনাভোটের তামাশার নির্বাচন হিসেবে এ নির্বাচনটি চিহ্নিত হয়।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। অস্থায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ নির্বাচনটি পরিচালনা করেন। এ নির্বাচনটি ইতিহাসের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে দেশ-বিদেশে স্বীকৃত হয়। নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৮৮টি আসন, জাতীয় পার্টি ৩৫টি এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ নির্বাচনটি বিতর্কিত। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেয়নি। তবে এ নির্বাচন ও গঠিত সংসদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয় এবং পরবর্তী চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়।
সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের অধীনে এ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি, বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি ও জামায়াতে ইসলামী ৩টি আসনে জয়ী হয়। জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেত্রী হন।
২০০১ সালে ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের অধীনে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি, আওয়ামী লীগ ৬২টি, জামায়াতে ইসলামী ১৭টি এবং জাতীয় পার্টি ও ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা।
সেনাসমর্থিত ১/১১-এর জরুরি সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি হয়। এতে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও বামপন্থি দলগুলো নিয়ে ‘মহাজোট’ গঠন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি, বিএনপি ৩০টি, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ তিনটি, জামায়াতে ইসলামী ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি আসনে জয়লাভ করে। ১/১১-এর জরুরি সরকারকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তাদের আন্দোলনের ফসল। ফলে জরুরি সরকারের কুশীলবরা ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ মাধ্যমে শেখ হাসিনার মহাজোটকে এমনভাবে বিজয়ী করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পায়, যা দেশের মানুষ কখনোই বিশ্বাস করেনি। তবু খালেদা জিয়া ফল মেনে নেন এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে জরুরি আইন উঠে যাবে, সেটা চিন্তা করে সংসদে যান এবং বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী হন শেখ হাসিনা।
এরপর দেশে সত্যিকার অর্থে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। শেখ হাসিনা কৌশল করে শুধু ক্ষমতা কবজা করেই রাখেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনাভোটের নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় (ভোটগ্রহণের প্রয়োজনই হয়নি) আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বাকি আসনে ভোটের দিন ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি।
তেমনি ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ নির্বাচনটি হয় দিনের ভোট রাতে হওয়ার মাধ্যমে। এটি ‘নিশিরাতের ভোটের’ নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পায়। আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় ক্যাডার ও পুলিশ বাহিনীর অসৎ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরে ফেলে। একইভাবে ২০২৪ সালে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচনে আমি ও ডামি প্রার্থী দিয়ে সব আসন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নেয়। নির্বাচনটি ডামি নির্বাচন হিসেবে পরিচিত। এই তিন নির্বাচনের তিন খলনায়ক সিইসি কাজী রকিবুল হুদা, কে এম নুরুল হুদা ও হাবিবুল আউয়াল সহসাই বিচারের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন।
সুন্দর নির্বাচনে হোক প্রাণবন্ত সংসদ
বিগত ১২টি নির্বাচনের মধ্যে দ্বিতীয়, পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম নির্বাচন ছিল ভালো নির্বাচনের সংজ্ঞা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। যদিও ওই নির্বাচন নিয়েও কমবেশি বিতর্ক আছে। আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচন যদি অন্তত সে রকমও হয়, মানুষ খুশি হবে। আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের মতো যদি ত্রয়োদশ নির্বাচনটি করা যায়, তাহলে সেটিই হবে ইতিহাসসেরা নির্বাচন। কারণ পঞ্চম সংসদ নির্বাচনটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি আদর্শ নির্বাচন। একটি সুন্দর নির্বাচন সব মানুষের প্রত্যাশা। সুন্দর নির্বাচন হলেই একটি কার্যকর এবং প্রাণবন্ত সংসদ হবে। দ্বিতীয় সংসদের মতো একটি প্রাণবন্ত সংসদ হোক। এ জন্য আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের জনপ্রিয় এবং অভিজ্ঞ নেতারা জিতে আসুকÑএটাই সবার চাওয়া।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ