Image description
হামলা শেষ করার পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর, সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিতে মর্টার, ইরানের পাল্টা জবাবের দিকে চোখ সবার

ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। দুই দেশের তীব্র উত্তেজনার মধ্যেই ইরানের সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। সিরিয়ায় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মর্টার হামলা হয়েছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাসাকাহ প্রদেশের কাসরুক এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। গতকাল ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসরুক অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে হঠাৎ করে মর্টার হামলা চালানো হয়। তবে এ হামলা কে করেছে, হামলার ধরন বা এতে কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে-সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ঘটনার পরপরই মার্কিন সেনারা পুরো ঘাঁটির চারপাশ ঘিরে ফেলে এবং ওই এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এলাকাজুড়ে সামরিক ড্রোন ও হেলিকপ্টারের টহল লক্ষ করা গেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে হতাহত হওয়ার খবর জানায়নি ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে ইরানে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ। তিনি বলেন, ‘নজিরবিহীন শক্তি’ দিয়ে ইরানে হামলা চালানো হচ্ছে। তেহরানে যেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা হয়েছে সেগুলোকে ‘শাসক গোষ্ঠীর প্রতীক’ বলে উল্লেখ করেছেন কাটজ। পূর্ণ শক্তিতে হামলা চলতে থাকবে, বলেছেন তিনি। কোন কোন লক্ষ্যে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছেন কাটজ। এর মধ্যে আছে, বাসিজ মিলিশিয়ার সদর দপ্তর। ইরান সরকার বিক্ষোভ দমনে প্রায়ই এই মিলিশিয়াকে কাজে লাগিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আছে ইরানের এভিন কারাগার। সেখানে রাজবন্দি এবং ইরানের শাসক গোষ্ঠীর শত্রুদের আটক রাখা হয়। এই কারাগারেও আঘাত হেনেছে ইসরায়েল। কারাগারের প্রবেশপথে বিস্ফোরণের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এ কথা নিশ্চিত করেছে বিবিসি ভেরিফাই। এ ছাড়াও নগরীর একটি ঘড়িতে আঘাত হেনেছে, যে ঘড়ি প্রতিনিয়ত ইসরায়েলের ধ্বংসের সম্ভাব্য দিনের সময় গণনা করে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সদর দপ্তরসহ সরকারসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভবনেও ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। সপ্তাহ শেষে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা এবং ইরানি ‘শাসক গোষ্ঠীর পরিবর্তন’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের পর ইরানের সামরিক নেতারা ‘চূড়ান্ত জবাব’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। বিশ্বে জ্বালানি সরবরাহের জন্য জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালি ইরান বন্ধ করে দিতে পারে বলেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

যুদ্ধ শেষ করতে চায় ইসরায়েল : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হামলার পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার আরব মিত্রদের মাধ্যমে ইরানের কাছে ইসরায়েলের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। আরব ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গতকাল মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেওয়া ছাড়া ইরান এখনই অভিযান শেষ করতে চায় না।

ইরানের ৬ বিমানবন্দরে হামলা : ইরানের পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের অন্তত ছয়টি বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। পাশাপাশি এসব হামলায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আকাশযান ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায় পশ্চিম, পূর্ব ও মধ্য ইরানের বিমানবন্দরগুলোতে রাতভর এই হামলা চালানো হয়েছে। পাশাপাশি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সামাজিক মাধ্যম ‘এক্সে’ এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ১৫টি বিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল মেহরাবাদ, মাশহাদ ও দেজফুল বিমানবন্দর। বিবৃতিতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, আপাতত ইরানের এসব বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশটির সেনাবাহিনী আকাশপথে কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না। হামলায় ইরানের বিমানবন্দরগুলোর রানওয়ে, বাংকার, একটি জ্বালানি ভর্তি উড়োজাহাজ ও ইরান সরকারের মালিকানাধীন এফ-১৪, এফ-৫ ও এএইচ-১ যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

তেহরানে বিপ্লবী গার্ডের সদর দপ্তরে হামলা : ইরানের রাজধানী তেহরানে দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সদর দপ্তরে হামলা চালানোর দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। হামলায় আইআরজিসির সৈন্য হতাহত হয়েছেন বলেও দাবি করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন। তিনি বলেছেন, তেহরানে চলমান ইসরায়েলি হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদর দপ্তরেও আঘাত হানা হয়েছে।

ইসরায়েল ইরানে তার লক্ষ্য পূরণের খুব কাছাকাছি- নেতানিয়াহু : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েল ইরানের ওপর পরিচালিত অভিযানে তাদের মূল লক্ষ্য অর্জনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বিশেষত দেশটির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ব্যাপক ক্ষতিসাধনের ক্ষেত্রে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েল দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়াতে চায় না, তবে লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধও করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বিত বিমান হামলার পর নেতানিয়াহু বলেন, হামলায় ‘অত্যন্ত গুরুতর ক্ষতি’ হয়েছে। তার দাবি, ইসরায়েল ‘হুমকি দূর করছে’ এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামিয়ে দিচ্ছে। নেতানিয়াহু বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি। তিনি ব্যাখ্যা করেন, হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে ২০২৪ সালে হত্যার পর ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল এবং তখনই অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে তিনি জানান, ইরান প্রতি মাসে ৩০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করছিল এবং গত ১০ দিনে দেশটির অর্ধেকের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে। নেতানিয়াহু আরও বলেন, ইসরায়েলের কাছে ‘মজার তথ্য’ রয়েছে, তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি। তার মতে, এই মাত্রার ইউরেনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং এর কোনো বেসামরিক ব্যবহার নেই।

কঠোর হুঁশিয়ারি ইরান সেনাপ্রধানের : যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব কঠোরভাবে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল আমির হাতামি। এমনকি ইরানের শক্তি নিয়ে সন্দেহ বা দ্বিধা না করতেও সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। সিএনএন বলছে, পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইরান ‘কঠোর প্রতিক্রিয়া’ জানাবে বলে ইরানের সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল আমির হাতামি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে আমেরিকার মুখোমুখি আমরা বহুবার হয়েছি। যখনই তারা আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছে, তারা তীব্র ও শক্তিশালী জবাব পেয়েছে।’

প্রতিশোধ কতটা তীব্র হবে ঠিক করবে সশস্ত্র বাহিনী : যুক্তরাষ্ট্র একটি বানোয়াট ও অযৌক্তিক অজুহাতে ইরানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ চাপিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি। রবিবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ডাকা জরুরি বৈঠকে তিনি বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্পষ্ট আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার রাখে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চাপেই যুক্তরাষ্ট্র ‘অযথা ও ব্যয়বহুল’ যুদ্ধে জড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ইরানি প্রতিনিধি।